প্রধান প্রতিবেদন

আল-জাজিরার প্রতিবেদন মিথ্যা: সেনাসদর

কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরায় প্রচারিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস ম্যান’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

গতকাল সোমবার রাতে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে পাঠানো এক প্রতিবাদলিপিতে এ কথা জানানো হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘পেশাগতভাবে অত্যন্ত দক্ষ, সবার কাছে অতি গ্রহণযোগ্য সেনাবাহিনী প্রধানকে কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়া আল জাজিরা কর্তৃক অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, ভিত্তিহীন এবং কাল্পনিকভাবে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত করার অপপ্রয়াস, যা সেনাবাহিনী ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে।’

আল জাজিরার প্রতিবেদনটি সেনাসদরের নজরে এসেছে জানিয়ে প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়েছে, ‘তথ্যচিত্র আকারে পরিবেশিত প্রতিবেদনটিতে আল জাজিরা কর্তৃক বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্পর্কে অসংখ্য ভুল তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে, এর ফলে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে।’

সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা সেনাবাহিনী প্রধানকে বাংলাদেশের জনগণ ও বিশ্বের দরবারে বিতর্কিত, অগ্রহণযোগ্য ও হেয়প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার সঙ্গে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অন্যান্য অসত্য, বানোয়াট, মনগড়া, অনুমাননির্ভর ও অসমর্থিত তথ্য সংযুক্ত করে প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে বলে আইএসপিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।

তথ্যচিত্রে দেখানো ইসরাইল থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্পাইওয়্যার কেনা এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্রয় প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সেনাপ্রধানের ভাইকে সম্পৃক্ত করে মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে প্রতিবাদলিপিতে।

আইএসপিআর বলছে, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ১৯৮৮ সাল থেকে সফলভাবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করে আসছে। ইতিপূর্বে বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে এবং বর্তমানে (৩১ আগস্ট ২০২০ থেকে অদ্যাবধি) ১২০টি দেশের মধ্যে জাতিসংঘে সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে।’

বিশ্বশান্তি রক্ষায় এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১২৪ সদস্য মারা গেছেন। আর আহত হয়েছেন ২২২ জন।

প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্জিত সুনাম, পারদর্শিতা, সক্ষমতা এবং অভিজ্ঞতার আলোকে অতি দ্রুত সময়ের মধ্যেই জাতিসংঘের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের শান্তিরক্ষী দল প্রেরণের জন্য প্রস্তুত থাকে।

প্রতিবাদলিপিতে আরও বলা হয়, ২০১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ইউএনডিপিও বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মতো ‘সিগন্যাল ইউনিটের পরিবর্তে একটি সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’ ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে মোতায়েন করতে সক্ষম কিনা জানতে চায়।

পাশাপাশি, উল্লেখিত ইউনিটের প্রয়োজনীয় জনবল ও সরঞ্জামাদির তালিকাও পাঠায় জাতিসংঘ। ওই তালিকা অনুযায়ী সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের জন্য সে সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কিছু সরঞ্জামাদি মজুত না থাকায় এবং সেগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করার প্রয়োজন দেখা দেয়।

ফলে ওই সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটটি ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের পর পাঠানো সম্ভব হবে বলে জাতিসংঘ ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি অবহিত করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

‘এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ কর্তৃক যথাযথ সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া অনুসরণ করে হাঙ্গেরি থেকে ডিসেম্বর ২০১৭-তে একটি প্যাসিভ সিগন্যাল ইন্টারসেপ্টর ক্রয়ের প্রক্রিয়া শুরু হয়, যা জুন ২০১৮-তে সম্পন্ন হয়।

‘এই সরঞ্জাম জাতিসংঘের চাহিদা মোতাবেক ক্রয় করা হলেও পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘ তানজানিয়ার একটি সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে মোতায়েন করায় ওই সরঞ্জামটি অদ্যাবধি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছেই অব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে এবং ভবিষ্যতে জাতিসংঘের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রেরণ করার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে।’

প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়েছে, ‘আল জাজিরা কর্তৃক উক্ত সিগন্যাল সরঞ্জাম ইসরাইলের তৈরি বলে যে তথ্য প্রচার করা হয়, তা আদৌ সত্য নয় এবং সরঞ্জামটির কোথাও ইসরাইলের নাম লেখা নাই।

‘সেনাবাহিনীতে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় এবং অনেকগুলো পর্যায় অনুসরণ করে সরঞ্জামাদি ক্রয় করা হয়। এখানে দুর্নীতি করার কোনো সুযোগ নেই।’

প্রতিবাদলিপিতে আরও বলা হয়, এই সিগন্যাল সরঞ্জামটির ক্রয় প্রক্রিয়া শুরু হয় বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ দায়িত্ব গ্রহণের অনেক আগে।

‘২০১৭ সাল থেকে শুরু করে পূর্বতন সেনাবাহিনী প্রধানের সময়কালে সেনাসদরের ক্রয়প্রক্রিয়া অনুসরণ এবং সরকার হতে অনুমোদন গ্রহণপূর্বক প্রতিরক্ষা ক্রয় মহাপরিদপ্তর (ডিজিডিপি) সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ২০১৮ সালের জুনে চুক্তি সম্পাদন করে।

‘অতএব উক্ত সিগন্যাল সরঞ্জামটির ক্রয় নিয়ে বর্তমান সেনাবাহিনী প্রধান বা হাঙ্গেরিতে বসবাসকারী তার ভাইয়ের কোনো যোগসূত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা যে সম্পূর্ণ অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’

সেনাপ্রধানের ভাইয়ের দীর্ঘ সময় হাঙ্গেরিতে বসবাসের বিষয়টিকে পুঁজি করে এই তথ্যচিত্র নির্মাণের বিষয়টি প্রতীয়মান হয়েছে বলেও উল্লেখ রয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে।

‘সেনাবাহিনী প্রধানের কোনো ভাই বা আত্মীয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কোনো ধরনের অস্ত্র, গোলাবারুদ বা সরঞ্জামাদি সরবরাহ অথবা ক্রয়প্রক্রিয়ার সঙ্গে কখনোই সম্পৃক্ত ছিলেন না।’

তাই এই তথ্যচিত্রটিকে দেশের ভেতরে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির অপপ্রয়াস হিসেবে দেখা হচ্ছে বলেও আইএসপিআর পাঠানো প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, ‌‘তথ্যচিত্রটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মতো একটি স্বনামধন্য এবং সুশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং তার পরিবারের ওপর কালিমা লেপনের মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর মতো একটি স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণ করে দেশের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা করার অপপ্রয়াসমাত্র।’

প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ সেনাপ্রধানের ছেলের বিবাহোত্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।

‘অথচ তার পূর্বেই সেনাবাহিনী প্রধানের ভাইগণ (আনিস ও হাসান) তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে ষড়যন্ত্রমূলক, পরিকল্পিতভাবে দায়েরকৃত সাজানো ও বানোয়াট মামলা থেকে যথাযথ আইনানুগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই অব্যাহতি পান।

‘ফলে ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ সেনাবাহিনী প্রধানের ছেলের বিবাহোত্তর অনুষ্ঠানে তার কোনো ভাই কোনো দণ্ডপ্রাপ্ত বা পলাতক আসামি অবস্থায় ছিলেন না, বরং সম্পূর্ণ অব্যাহতিপ্রাপ্ত হিসেবেই তারা ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন এবং উক্ত সময়ে তাদের বিরুদ্ধে আর কোনো মামলা অনিষ্পন্ন অবস্থায় বা চলমানও ছিল না।’

এরপর ২০১৯ সালের এপ্রিলে সরকারি সফরে সিঙ্গাপুর ভ্রমণ শেষে ব্যক্তিগত সফরে মালয়েশিয়া যান সেনাবাহিনী প্রধান। সেখানে বড় ভাইয়ের বাসায় অবস্থান করেন তিনি।

‘অতএব বিষয়টি স্পষ্ট যে, প্রতিবেদনে দেখানো সেনাবাহিনী প্রধানের প্রবাসী ভাইয়ের সাথে বিবাহ অনুষ্ঠানে এবং মালয়েশিয়াতে সাক্ষাতের ঘটনাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পলাতক আসামির সঙ্গে সাক্ষাৎ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা একটি নির্লজ্জ অপপ্রচারমাত্র।’

প্রতিবাদলিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে, আল জাজিরার প্রতিবেদনে ‘সামি’ নামের যে ব্যক্তির বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে, তার প্রকৃত নাম সামিউল আহমেদ খান। তার পিতার নাম অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল মরহুম আব্দুল বাসিত খান।

বলা হয়েছে, ‘সামিকে ইতিপূর্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং মিলিটারি পুলিশ কর্তৃক চুরি, সেনাবাহিনীর অফিসারের পোশাক এবং ভুয়া পরিচয়পত্র ব্যবহার করে প্রতারণার অপরাধে বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার করা হয়। এসব অপরাধের দায়ে ২০০৬ সালে তাকে বাংলাদেশের সব সেনানিবাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়।’

প্রতিবাদলিপিতে আরও বলা হয়েছে, সামিউল আহমেদ খান নিজের নাম বদলে হয়েছেন জুলকারনাইন সায়ের খান। তার ব্যবহার করা বর্তমান পাসপোর্ট নম্বর : ইজি ০০৯২৯০২। আর আগের পাসপোর্ট নম্বরগুলো হলো: বিজে ০৫২০২৬০, এসি ৫০৭৫৬৪৭ এবং বি ১৭৬৫৬৪৯। বাবার নাম পাল্টে করেছে কর্নেল ওয়াসিত খান। এই ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে পলাতক অবস্থায় হাঙ্গেরিতে বসবাস করছে।

‘এই প্রতারক, অর্থলোভী ও জালিয়াত সামির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণার অভিযোগে রমনা মডেল থানায় ২০২০ সালের ৫ মে একটি মামলা (নম্বর ২/৫/২০২০) করা হয়, যা বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে।’

বিভিন্ন সময়ের কিছু খণ্ড খণ্ড ছবি বা দৃশ্য সংযোজন করে একটি অনুমাননির্ভর, অগ্রহণযোগ্য ও প্রমাণবিহীন তথ্য দিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে তথ্যচিত্রটির সম্পাদনা করা হয়েছে বলেও জানিয়েছে আইএসপিআর।

‘প্রতিবেদনের প্রায় সম্পূর্ণ বিষয় অসমর্থিত শোনা কথানির্ভর এবং তথ্য প্রদানকারীকে অপরপক্ষ কর্তৃক কোনো প্রশ্ন বা জেরার মুখোমুখিও করা হয়নি। এ ছাড়া সামির মতো একজন প্রতারক ও পলাতক ব্যক্তির কাছ থেকে একতরফাভাবে প্রাপ্ত ও সাক্ষ্য হিসেবে অনির্ভরযোগ্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে ভিত্তিহীন তথ্যচিত্র তৈরি করার কারণে এই প্রতিবেদন গ্রহণযোগ্যতা, প্রাসঙ্গিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

‘প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান ও তার পরিবারকে সরাসরি মাফিয়া পরিবার হিসেবে উল্লেখ ও উপস্থাপনের প্রয়াস নেয়া হয়েছে। একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশের সরকার কর্তৃক আইন অনুযায়ী নিযুক্ত সেনাবাহিনী প্রধান সম্পর্কে সাংবাদিকতার রীতি ও নীতি গর্হিতভাবে এরূপ অপবাদ ও মিথ্যাচার চূড়ান্তভাবে অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত এবং আল জাজিরার মতো একটি সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকে আদৌ কাম্য নয়।’

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button