
প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী লতা মুঙ্গেশকরের গাওয়া মুকুল দত্তের লেখা আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই যে বিখ্যাত গান- আষাঢ় শ্রাবণ/ মানে না তো মন/ ঝরো ঝরো ঝরো ঝরো ঝরেছে/ তোমাকে আমার মনে পড়েছে…। আজও অঝোর ধারা বৃষ্টির দিনে মনকে কেমন শূন্য করে দেয়! বহুদূরের ওপার থেকে যেন স্মৃতিমেদুর বিরহ বার্তা নিয়ে আসে বর্ষার ভেজা বাতাস। কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যের সেই বিরহী মেঘমল্লারের টানে প্রাণ কেমন আকুল হয়ে ওঠে। যক্ষের বিরহ বার্তা নিয়ে ছুটছে মেঘের পরে মেঘ কোনো দূর অজানায়! রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে ইচ্ছে হয়-
এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘন ঘোর বরিষায়!
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে
তাপনহীন ঘন তমসায়।
আসলে কাকে বলতে চায় মন, তার গহন মনের সেই অব্যক্ত কথাগুলো? কে সে, যাকে মনের গোপন কথাটি বলে দিতে ইচ্ছে করে এমন বাদল দিনেই! কেন নয় অন্য কোনো রোমান্টিক সময়ে? নয় কেন পুষ্পশোভিত ঋতুরাজ বসন্তে?
এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। কারণ বর্ষায় এমনই এক মেঘমেদুর বেদনাবিধুর আবহ আছে, যেখানে টিনের চালে বৃষ্টির সুরে নূপুরধ্বনি কল্পনা করা গেলেও বর্ষার একটা গভীর বোধ মানুষের মনের গহনে ছড়িয়ে যায়। যার নাম নিঃসঙ্গতা। আরও সহজ করে বললে, নিজেকেই নিজের করে একান্তে পাওয়ার মুহূর্ত নিয়ে আসে বর্ষণমুখর মুহূর্তগুলো।
রবীন্দ্রনাথ-নজরুলসহ বাংলা ভাষার প্রধান কবিদের কবিতায় বর্ষাকে ঘিরে সেই নিঃসঙ্গ মনের একান্ত ভাবনা নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সেই যে ‘সোনার তরী’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আকুতি-
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
ক‚লে একা বসে আছি, নাহি ভরসা…।
এই যে গভীর তাৎপর্যময় নদীক‚লে একা বসে থাকার মুহূর্ত- এ যেন জীবন-মৃত্যুর অনিবার্য বাস্তবতা। আউশ ধানের মৌসুম আষাঢ়-শ্রাবণে ধান কাটার দৃশ্য কবি তীব্র স্রোতের নদীতীরে বসে উপলব্ধি করেছেন। এই বাস্তবতা ইহকাল-পরকালের প্রতীকে আসলে কবি মানুষের একাকিত্বই অনুভবে ছড়িয়ে দেন। কিংবা নজরুলের গান যখন শুনি- শাওন আসিল ফিরে, সে ফিরে এল না… তখন মনের গভীরে এক বিরহী চরিত্রের আর্তনাদেরই প্রতিধ্বনি পেয়ে যাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলামের কবিতা, গানে বর্ষা যে কতবার কতরূপে উদ্ভাসিত, তা লিখে শেষ করা যাবে না। বর্ষার নানা রূপ বাংলার কবিদের মনোলোকে নানাভাবে দোলা দিলেও ব্যতিক্রম কবি জীবনানন্দ দাশ। তার কবিতায় বৃষ্টি আর বর্ষা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। হয়তো কোনো দিন কোনো গবেষক এসে আবিষ্কার করবেন, এত বড় বিষণ্ন তার কবি, নির্জনতার কবির মনোজগতে বর্ষা কেন অনুপস্থিত!
যা-ই হোক, বাংলা কবিতায় বর্ষা নিয়ে যদি এই নিবন্ধ হতো, তাহলে এ প্রসঙ্গের সম্প্রসারণ ঘটানো যেত। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য, বর্ষার সার্বিক চিত্র। বর্ষায় জীবনযাত্রা, শস্যের চাষাবাদ, মৎস্য আহরণ, আবহাওয়াসহ আরও কত বিচিত্র দিক। সেদিকে দৃষ্টিপাত করার আগে এ তথ্যও পাঠকদের জানানো দরকার যে, বর্ষা কেবল বিরহ-যন্ত্রণা আর দুঃখ-কষ্টের ঋতুই নয়, বর্ষার একটা আনন্দময় রূপও আছে। না হলে রবীন্দ্রনাথ প্রবল বাদল দিনে ‘ওরে আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে’ বলে সতর্ক করেন কেন। তিনিই কেমন করে এমন আনন্দ-দৃশ্য কল্পনা করেন-
শতেক যুগের কবিদলে মিলি আকাশে
ধ্বনিয়া তুলিছে মত্তমদির বাতাসে
শতেক যুগের গীতিকা
শত শত গীত মুখরিত বনবীথিকা।
বর্ষার শস্যশ্যামল সজীব রূপের তাৎপর্য একেবারে কম নয়। চৈত্র-বৈশাখ-গ্রীষ্মেও প্রচণ্ড দহনে চৌচির মাঠঘাট এক পশলা বৃষ্টির আশায় যেমন উন্মুখ হয়ে থাকে। প্রবল দাবদাহে জীবন ওষ্ঠাগত প্রায়। ‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে’ বলে সেই সুদূর অতীত থেকে মানুষের আর্তি! সেই তাপদগ্ধ ধূলিধুসর গ্রীষ্মের পরেই তো আসে শান্তির স্নিগ্ধ কোমল বারিধারা নিয়ে আষাঢ়-শ্রাবণ। কঠিন কঠোর ফেটে যাওয়া শক্ত মাটি কী অনাবিল স্নিগ্ধতায় নরম পলিতে পরিণত হয় বর্ষার বৃষ্টি পেয়ে। আউশকাটা শূন্য মাঠে আমন আর বোরো ধানের চারা কৃষক রুয়ে দেয় সেই পলিমাটির কোমল বুকে। বাংলার গ্রামগঞ্জে বর্ষার চিরচেনা সেই চিত্র আজও বহমান। যদিও আগের মতো সেই স্বাভাবিকতা এখন আর নেই। আমরা গাছপালা নিধন করে, বেহিসেবী কার্বন নিঃসরণ ঘটিয়ে ধ্বংস করে ফেলেছি আমাদের ঋতুচক্রের স্বাভাবিকতা। যে কারণে শীতের মৌসুমে শীত নেই, বর্ষায় স্বাভাবিকতা নেই বৃষ্টিরও। খরা-বন্যা-তাণ্ডবে বিষণ্ন জনজীবন। গাছপালাশূন্য হয়ে পড়েছে চরাচর। বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বহু প্রজাতির উদ্ভিদ আর পাখি, বন্যপ্রাণি।
এ রকম এক বিপর্যস্ত বাস্তবতায় যখনই পেছন ফিরে তাকাই, তখনই ফিরে আসে আমার কৈশোরের সেই বর্ষাকাল, যেখানে সত্যিকার শ্যামল-সবুজ প্রকৃতির সঙ্গে বর্ষার নিবিড় বন্ধন আর মুষলধারার বৃষ্টিতে মাঠঘাট, খালবিল ডুবে যাওয়া আষাঢ়-শ্রাবণ। এতকাল পরে আজ বুঝতে পারি, সেই বর্ষা ঋতু ছিল অত্যন্ত প্রবল। কী যে দুর্বিষহ ছিল সেই ভারী বৃষ্টির তাণ্ডব। অবিরাম ঝর ঝর বৃষ্টি ঝরত, কখনো টানা ৪-৫ দিন। পাকিস্তানি সামরিক শাসন কবলিত পূর্ব বাংলায় ছিল না তেমন রাস্তাঘাট বা উন্নয়ন অবকাঠামো। রাষ্ট্রের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে চরম অর্থনৈতিক বৈষম্যে। গরিব মানুষ দিন দিন আরও গরিব হয়েছে। বর্ষায় অভাব-অনটনের ভয়াল চিত্র, তার সঙ্গে আশ্চর্য মিল ছিল আমার শৈশব-কৈশোর দেখা পূর্ব বাংলা যেন বিভ‚তিভ‚ষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’র সামাজিক প্রতিচ্ছবি। যেখানে দারিদ্র্যক্লিষ্ট আর বর্ষণক্লান্ত গ্রামবাংলার ছবি ফুটে উঠেছে, পঞ্চাশের দশকের শেষ ভাগ থেকে ষাটের দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত সেই দারিদ্র্য-বাস্তবতার মধ্যে কেটেছে আমাদের শৈশব-কৈশোর। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে আউশ ধান উঠত। হাতেগোনা সচ্ছল কৃষক ছাড়া অধিকাংশ মানুষ অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাত। প্রিয় জন্মভ‚মি পূর্ব বাংলা যেন বর্ষায় ভেজা অসহায় কাকের মতো আশ্রয় খুঁজত বাদলের তাণ্ডব থেকে আত্মরক্ষার জন্য। ‘পথের পাঁচালী’র অপু-দুর্গার মা জনম-দুঃখিনী সর্বংসহা সর্বজয়ার সঙ্গে তুলনা করতে ইচ্ছে হয় শৈশব-কৈশোরের বাংলাকে। চরম অভাব-অনটনে জর্জরিত। বিশেষ করে আষাঢ়-শ্রাবণ এবং ভাদ্র-আশ্বিন কালপর্বে গ্রাম বাংলায় চরম অভাব-অনটন হতো। অধিকাংশ মানুষের ঘরবাড়ি ছিল খড় অথবা শনে ছাওয়া। অনেকে ৫ থেকে ১০ বছরের পচে যাওয়া খড় বা শন বদল করে বাসস্থান সংস্কার করতে পারত না। অভাবের তাড়নায় মানুষ কচু, শাক, লতাপাতা জোগাড় করে কোনো রকম ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করত।
কিন্তু অবুঝ শৈশব-কৈশোরে আমরা মানুষের এই গভীর দুঃখ-কষ্ট বুঝতে পারিনি। বরং বর্ষা এলে মেতে উঠতাম নানা রকম বৃষ্টিভেজা খেলায়। বাড়ির খোঁড়া উঠোনে কিংবা খোলা জায়গায় জাম্বুরা দিয়ে, কখনো কাটা শক্ত কাগজের টুকরো, বোর্ড, পাটের রশি এগুলো জোড়া দিয়ে বেঁধে ফুটবল বানিয়ে ছুটতাম বৃষ্টির মধ্যে। ভিজতে ভিজতে কখনো জ্বরে পড়তে হয়েছে।
সচ্ছল কৃষকদের জমিতে আউশ ধানের চারা রুয়ে দিতে দিতে কৃষকশ্রমিকদের দল বেঁধে সারিগান-পালাগানের আসর চলত। হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতি ও চরিত্র নিয়েও উতর চাপান চলত দুই বয়াতী কবিয়ালের মধ্যে। ‘গোপাল আমার দুধের শিশু গোষ্ঠে দেব না সখিগো’ বলে শ্রীকৃষ্ণের মায়ের আর্তির অর্থ বুঝতাম না। কিন্তু বয়াতি কবিয়ালের সুরে মজে থাকতাম। ‘ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম’ এমন রহস্যময় সৃষ্টিতত্ত¡ নিয়েও গ্রামীণ বয়াতী কবির সুরের লড়াই।
যা-ই হোক, আষাঢ়-শ্রাবণের সেই বর্ষার স্মৃতির মধ্যে অবোধ শিশুমনের আনন্দ যেমন মিশে আছে, তেমনই স্মৃতি হয়ে আছে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অবিরাম বৃষ্টির দিনে প্রকৃতিতে নিমগ্ন হয়ে থাকা কত সকাল-দুপুর-বিকেল। আমন চারা লাগানোর জন্য মাঠ তৈরির সময় ছপছাপ জলকাদার মধ্যে মইয়ের পেছনে গরুর লেজ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা আর মইয়ের ছুটে চলার কত আনন্দঘন মুহূর্ত স্মৃতির মধ্যে জমে আছে! প্রচুর মাছ ছিল তখন নদী-পুকুর আর খাল-বিলে। এমনকি আউশের জমিতে কাদাপানির মধ্যেও কই মাছ ধরেছি কত! খালগুলোর সংযোগ ছিল কয়েক কিলোমিটার দূরের নদীর সঙ্গে। মেঘনা, তেঁতুলিয়া এসব নদী আমার জন্মস্থান দ্বীপজেলা ভোলাকে তিন দিক বেষ্টন করে আছে আজও, শুধু দক্ষিণ দিক সীমাহীন বঙ্গোপসাগর। বর্ষার পানিতে পুকুর ভরে গিয়ে পুকুরের মাছ বেরিয়ে পড়ত চাষের জমিতে-বিলে। সেই প্রাকৃতিক মাছের উৎস আজ গল্পের মতো মনে নেই। বাড়ির পাশে খালে ডুবে সাঁতার দিয়ে কত রকমের মাছ ধরেছি খালি হাতে কাদা হাতড়ে!
আজ যখন আষাঢ়-শ্রাবণের গাথা লিখতে বসেছি, তখন কোথায় সেই জোয়ার-ভাটার ভরা খাল! কোথায় খালপাড়ের অসংখ্য কেয়াঝোপ আর বৃষ্টিভেজা অসংখ্য কদম ফুল। বাংলার অবারিত সবুজ নিসর্গ আমরা প্রয়োজনে যেমন নষ্ট করেছি, তেমনি অপ্রয়োজনেও কম নষ্ট করিনি। গাছ কাটি কিন্তু গাছ লাগাই না। প্রকৃতি হত্যার মধ্য দিয়ে আমরা ঋতুর গতিপথ যেমন পাল্টে দিয়েছি, তেমনই ঋতুর চেহারা-চরিত্রও বদলে দিয়েছি। যে কারণে এখন বর্ষায় বৃষ্টি হয় না, অথবা অতিবর্ষণে সব নষ্ট হয়ে যায়। শীতের মৌসুমে শীত পড়ে না। বর্ষায় বৃষ্টির অভাবে আমনচাষী আমন ধানের চারা লাগাতে পারেন না। অথচ কখনো দেখি শরতে কিংবা হেমন্তে মুষলধারার বৃষ্টি নামে! আজ থেকে ৫০ বছর আগের বাংলাদেশে যে বিপুল সবুজ আর প্রাকৃতিক ভারসাম্য ছিল, আজ তার ছিটেফোঁটাও নেই। নিসর্গ হত্যার মতোই লুটপাটের অর্থনীতি, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সুদখোর ছদ্মবেশী উপনিবেশে পিষ্ট হয়েছে বাংলাদেশ যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশটা লুটেরাদের হাতে চলে যায়। প্রকৃতি বিনাশের মতোই বিনষ্ট হয়েছে অর্থনৈতিক ভারসাম্যও। যে কারণে দরিদ্র কেবলই দরিদ্র হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেই বিধ্বস্ত বাংলাদেশ গত এক যুগে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দৃশ্য-অদৃশ্য ঔপনিবেশিক শক্তির খবরদারি থেকে বেরিয়ে এসেছে অর্থনৈতিক মুক্তির বিশাল রাজপথে।
মধ্যম আয়ের পথে দ্রুত বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। এখন প্রয়োজন প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার দিকে আমাদের সবার মনোযোগ। বেশি বেশি মনোযোগ। একটা গাছ কাটলে দুটো গাছ লাগাবার আকাক্সক্ষা। তাহলে আবার প্রকৃতি খুঁজে পাবে তার হারানো ভারসাম্য। বর্ষার সজল কালো মেঘ বাংলাদেশ এবং তার সবুজ প্রকৃতিকে উজ্জ্বল করে তুলবে। মুখস্থ বিদ্যার বর্ষা সৌন্দর্য নয়, রচনা বইয়ের শ্যামল নিসর্গ-প্রকৃতি নয়, বাস্তবেই বাংলাদেশ হয়ে উঠবে সবুজ শ্যামল শস্যবতী। এক দশক ধরে বিশ্বজুড়ে আবহাওয়া জলবায়ু তথা পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভ‚মিকা এক্ষেত্রে অত্যন্ত উজ্জ্বল। এখন দেশবাসী তথা জনসাধারণের সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি।
বর্ষার প্রসঙ্গেই এসে যায় পানি সংকটের বিষয়টিও। বর্ষাকালে যে বৃষ্টিপাত হয়, তা আরও বাড়ানো সম্ভব গাছপালা লাগিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য পুনর্বহালের মাধ্যমে। বর্ষকালে যদি আমরা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করতে পারি, তাহলে আমাদের সুপেয় পানির সংকট যেমন মোচন করা সম্ভব, তেমনই সেচ আর কৃষিকাজের জন্যও সারা দেশে পানি সংরক্ষণ করা সম্ভব। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা যদি এ নিয়ে কার্যকর উপায় বের করতে কাজ শুরু করে, বিশ্বাস করি বর্ষা মৌসুম আমাদের পানিসংকট মোচনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।
একই সঙ্গে নগরজীবনে গত প্রায় ৪৮ বছর বসবাসের অভিজ্ঞতা থেকে যে উপলব্ধি হয়েছে, তা-ও বলা প্রয়োজন। বর্ষার বৃষ্টি অনেক ক্ষেত্রে আশীর্বাদ বয়ে আনলেও রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় নগরে বর্ষাকালে যে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা বয়ে আনে, তা চরম দুর্গত বৈ আর কিছু নয়। এর মূল কারণ, ড্রেন তথা সুয়ারেজ সিস্টেমের চরম অব্যবস্থাপনা। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে ঢাকায় যে খালগুলো দেখেছি, তা ক্ষমতাসীন সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় ভ‚মিদস্যুচক্র দখল করে নিয়েছে। যে কারণে রাজধানীতে ২ ঘণ্টা প্রবল বৃষ্টি হলেই রাস্তাঘাট ডুবে যায়। পানি সরানোর কোনো পথ নেই। প্রতি বর্ষায় সীমাহীন দুর্ভোগে পড়ে লাখ লাখ মানুষ। এই চিত্র শুধু রাজধানী নয়, বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ অনেক বড় শহরেই সুয়ারেজর তথা ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত শোচনীয় । সম্প্রতি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ঢাকার চারপাশে বেদখল হয়ে যাওয়া নদীর জমি থেকে দখলদার উচ্ছেদ এবং ঢাকার মূল খাল পুনরুদ্ধার অভিযান জোরদার করেছেনÑ এটা অত্যন্ত আশার কথা। সম্ভবত এ প্রসঙ্গেই লেখা জরুরি যে, ঢাকায় যে হারে বহুতল ভবন বেড়েছে এবং এখনো নির্মাণ চলছে, তাতে পানির স্তর মারাত্মকভাবে নেমে গেছে এবং আরও নামবে। যা ভ‚মি কিংবা ভ‚মিধসের মতো অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে। ধসে পড়বে বহুতল ভবনও। এ অবস্থায় হাজার হাজার ডিপ টিউবওয়েল প্রতিদিন পানি শুষে আনছে ঢাকার ভ‚তল থেকে। এ অবস্থা অত্যন্ত উদ্বেগের, ভয়াল বিপজ্জনক। বর্ষার পানি ধরে রাখা গেলে ডিপটিউবওয়েলের ব্যবহার কমানো সম্ভব। সংরক্ষণ থেকে প্রয়োজনীয় পানির চাহিদাও মিটানো সম্ভব।
বর্ষা তথা আষাঢ়-শ্রাবণের প্রকৃতি আর মানুষের মনে বর্ষার বিপুল প্রভাবের কথা লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশ্রয় নিয়ে শুরু করে কবিতা থেকে চলে এলাম এক কঠিন কঠোর বাস্তবতার মধ্যে। পাঠক হয়তো বা হোঁচট খেতে পারেন। পাঠক হয়তো বাদল দিনের স্মৃতির মেঘমালায় ভেসে হারিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে আমরা তো হারিয়ে যেতে পারি না। মেঘ জমে আছে মনে, কখনো প্রকৃতিতে। কিন্তু সেই মেঘে বৃষ্টি ঝরে না, বুকের ভেতরটা যেন তৃষ্ণায় চৌচির হয়ে আছে। তৃষ্ণা-পোড়া কাঠ যাকে বলে। অনুভবে অজস্র বর্ষার ঝরঝর। মনে হয় কালিদাসের বিরহী যক্ষের মতো আমাদের মনও কোনো স্বপ্নের উজ্জয়িনীপুরে বার্তা পাঠাতে চেয়ে মেঘের সন্ধান করতে করতেই জীবনের পথ কেবলই প্রলম্বিত হয়। হতে হতে এক সময় ফুরিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটকের রাজা কিংবা কবি কালিদাসের সৃষ্ট যক্ষের বিরহ-যন্ত্রণার চেয়ে কম নয় আমাদের এই দুঃখবোধ। বৃষ্টি আমাদের একান্তে যত সুখের স্মৃতি জমা করেছে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি দীর্ঘশ্বাস স্মৃতিই সঞ্চিত করে রেখেছে। প্রবল বৃষ্টি আজকাল কম হয় এ কথা সত্য, কিন্তু যখন হয় তখন কেন যেন কবি অমিয় চক্রবর্তীর সেই দুঃখ জড়ানো পঙ্ক্তি মনকে এলোমেলো করে দেয়- ‘কেঁদেও পাবে না তারে বর্ষার অজস্র জলাধারে…’। আমাদের প্রত্যেকের চেতন কিংবা অবচেতন মন যেন কাউকে খুঁজে বেড়ায় আজীবন। লালন ফকির যাকে বলেন মনের মানুষ। বর্ষার বাদলধারা আমাদের মনকে বারবার নিঃসঙ্গ করে দেয়। আর আমাদের মন বলে ওঠে- তুই ফেলে এসেছিস কারে মন/মনরে আমার…।
লেখক: নাসির আহমেদ/ কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক