বিজয়ের দিনে এক বাংলাদেশির বিজয়ের খবরই বটে। বাংলাদেশি কোচ শহিদুল আলম রতনের নাম জুড়ে গেল ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ভেন্যু দি ওভালের নামের সঙ্গে। প্রতীকী সম্মান হিসেবে ‘কিআ শহিদুল আলম রতন ওভাল’ নামটি থাকবে ২৪ ঘণ্টা।
ইংল্যান্ডের সারে কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবের মাঠ ওভাল ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত মাঠগুলোর একটি। ১৮৮০ সালে এ মাঠে নিজ দেশে প্রথম টেস্ট খেলেছিল ইংল্যান্ড। সারের সঙ্গে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কিআ’র স্পন্সরশীপ চুক্তি অনুযায়ী মাঠটির নাম অনেকদিন ধরে ‘কিআ ওভাল’। গতকাল মঙ্গলবার তাদের ওয়েবসাইটে একদিনের জন্য এ নামের সঙ্গে রতনের নাম জুড়ে দেওয়ার কথা জানানো হয়েছে।
পেছনের গল্পটি বেশ মনকাড়া। ‘ক্যাপিটাল কিড ক্রিকেট’ নামের একটি সেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান নির্বাহী রতন। সংস্থাটি ইংল্যান্ডের আরও হাজার বেসরকারী উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের মতো সরকারী বিভিন্ন সংস্থা থেকে অনুদান পেয়ে থাকে। করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউনের সময় সংস্থাটি নেয় দারুণ উদ্যোগ।
‘ন্যাশনাল লটারি ফাউন্ডেশনের’ অনুদান নিয়ে তারা লন্ডন ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহরের তৃণমূল পর্যায়ের ক্রিকেটারদের পাশে দাঁড়ায়।
পুরো কার্যক্রম পরিচালনায় ছিলেন রতন। পুরস্কার হিসেবে ন্যাশনাল লটারি ও সারে কাউন্টি ক্লাব রতনকে দিল এ সম্মান।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ কোচ ও উদ্যোক্তা বলেছেন, ‘ন্যাশনাল লটারি ও সারে কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাব আমাকে বেছে নেওয়ায় আমি নিজেকে সম্মানিত মনে করছি। আজ ১৫ ডিসেম্বর আমার জীবনের সেরা স্মৃতি হয়ে থাকবে। আমার ক্রিকেটীয় কার্যক্রমের পেছনে যারা সমর্থন যুগিয়েছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ।’
সারের ক্রিকেটার আমির ভিরদি আর রায়ান প্যাটেল জানান, রতনে উদ্যোগের কারণে প্রচুর তরুণ ক্রিকেটার উপকৃত হয়েছেন।
২০০১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে চাকরি করেছেন রতন। কাজ করেছেন হাই পারফরম্যান্স ইউনিটে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ইংল্যান্ডে বসবাস করছেন।
তিনি বলেন, ‘এটা অনেক বড় সম্মান। আমি বুঝিয়ে বলতে পারছি না। এটা আসলে অনেক বড় অনার। তবে আমি বলবো, এটা আমার একার সম্মান নয়। আমি বলবো, এটা আমার একার নাম নয়। এটা বাংলাদেশের নাম। আমি আজ একজন বাংলাদেশী হিসেবে গর্বিত।’
রতন আদ্যোপান্ত বাংলাদেশী। ছিলেন উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান। খেলেছেন ওয়ারী থেকে মোহামেডান; নিয়মিত ঢাকার ক্রিকেট। এমসিসির হয়ে আন অফিশিয়াল বাংলাদেশ জাতীয় দলেও খেলেছেন। তবে অল্প বয়সেই নব্বই দশকের মাঝামাঝি ক্রিকেট ছেড়ে দ্রুতই কোচিংয়ে চলে আসেন। ইংল্যান্ড থেকেই কোচেস কোর্স তিন লেভেল সম্পন্ন করেন। এর মধ্যেই দেশে ক্লাব ক্রিকেটে কোচিং শুরু করেন।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের চাকরি ছেড়ে চলে যান মালয়েশিয়াতে। সেখানে মালয়েশিয়া যুব দলের কোচ হিসেবে বিশ্বকাপেও কাজ করেছেন। আর মালয়েশিয়া থেকেই তাকে লন্ডনে নিয়ে যায় ক্যাপিটাল কিড ক্রিকেট। শুরুতে তাদের গেম ডেভেলপমেন্ট কর্মকর্তা ও কোচ হিসেবে কাজ করলেও গত কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন প্রধাণ নির্বাহী হিসেবে।
এই সংস্থার দায়িত্ব নিয়ে রতন ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন ইংল্যান্ডের তৃনমূল পর্যায়ে। নিজেদের কাজ সম্পর্কে তিনি বলছিলেন, ‘আমরা সারে, মিডলসেক্সসহ বিভিন্ন কাউন্টি ক্লাবের সাথে কাজ করি। মূলত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ক্রিকেটের সাথে রাখার জন্য অলাভজনক সংস্থা হিসেবে কাজ করি আমরা।’
এ কাজটিই তারা জোরদার করলেন লকডাউনের সময়।
ইংল্যান্ডের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইডেন, লেবাননে সুবিধাবঞ্চিত ক্রিকেটাররা তাদের সুবিধা নিয়েছে।
লকডাউনের সময়ে নিজেদের কাজ নিয়ে রতন বলছিলেন, ‘এই সময়টা অল্পবয়সী ক্রিকেটারদের জন্য কঠিন ছিলো। তারা হতাশ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিলো। আমরা তাই ওদের জন্য নানা ধরণের অনলাইন ক্লাস, অনলাইন কোর্স নিয়ে এলাম। আমরা ধীরে ধীরে এটা লন্ডনের বাইরে, এমনকি ইংল্যান্ডের বাইরেও ছড়িয়ে দিলাম। আমাদের এই ফান্ডটা দিচ্ছিলো ন্যাশনাল লটারি। আমাদের কোচিং দলকে আমরা বলেছি, এমনভাবে কোচিং সেটআপ করতে, যেটা যেনো যে কোনো ঘরেই করা সম্ভব হয়।’
আর ইংল্যান্ড সরকারের এ সংস্থাটি তাদের তহবিল পাওয়া কয়েক হাজার সংস্থার ভেতর থেকে ৬ জন স্বেচ্ছাসেবীকে বেছে নিলো। ৬টি ক্রীড়া স্থাপনার সাথে তারা চুক্তি করলো যে, এই ৬ জনকে সম্মান জানাতে স্থাপনাগুলোর নাম ২৪ ঘন্টার জন্য পাল্টে ফেলা হবে। তারই ফল হিসেবে এই কিআ ওভালের নামকরণ।
রতনের এই কর্মকান্ডের বিপুল প্রশংসা করেছেন ইংল্যান্ডের ক্রীড়া বিভাগ। আর রতন যখন এইসব কথা বলছিলেন, চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছিলো কিআ ওভালের নতুন নাম ফলকটা। যেনো সেখানে রতনের নাম লেখা নেই। লেখা আছে- দি বাংলাদেশ ওভাল।