
করোনার কারণে শিক্ষকের হাতে মাতৃভাষা পদক তুলে দিতে না পারায় ক্ষমা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সঙ্গে শহীদ মিনারে ফুল দিতে না পারায় আক্ষেপ করেছেন তিনি।
আজ রোববার বিকেলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে প্রথমবারের মতো দেয়া হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক। এবার পদক দেয়া হয়েছে তিন ব্যাক্তি ও এক প্রতিষ্ঠানকে। তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষক জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামও।
পদক প্রদান অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হন সরকার প্রধান। আর অনুষ্ঠানস্থলে তার হয়ে পদক তুলে দেন শিক্ষামন্ত্রী দিপুমনি।
এ সময় আক্ষেপ করে মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার দুঃখ এখানেই থেকে গেল যে, আমি নিজে উপস্থিত থাকতে পারলাম না। বিশেষ করে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক রফিকুল ইসলাম সাহেবের হাতে পদক তুলে দেয়া, এটা যে আমার জন্য কত সম্মানের আর গৌরবের। আমার দুঃখ এখানেই আমি নিজের হাতে দিতে পারলাম না। স্যার আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘করোনা ভাইরাসের কারণে আসলে প্রধানমন্ত্রী হলেও সব স্বাধীনতা থাকে না, একটা বন্দি জীবন যাপন করতে হয়। সে রকমই আছি। কারণ, আমি এক জায়গায় যেতে গেলে আমার সঙ্গে বহুলোক, নিরাপত্তার লোক, কর্মকর্তার যেতে হয়। তাদের কথা চিন্তা করেই কিন্তু আমি আসিনি।’
ঢাকায় অবস্থান করেও এই প্রথম ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে যেতে না পারার কারণেও আক্ষেপ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘করোনার জন্য আজকে শহীদ মিনারে যেতে পারলাম না। বাংলাদেশে ঢাকায় অবস্থান করে শহীদ মিনারে যেতে পারবো না এটা কখনো হয়নি। একেবারে ছোট থেকে শহীদ মিনারে যাচ্ছি। এবারই প্রথম যেতে পারলাম না, এজন্য একটা দুঃখ থেকে গেল। আমি এক জায়গায় যেতে গেলে বহুলোকের দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই এবং এই করোনা ভাইরাস থেকে তারা যেন সুরক্ষা পায় সে কথা বিবেচনা করে দীর্ঘদিনের এই অভ্যাস, এই আকাঙ্ক্ষাটা পূরণ করতে পারলাম না। তবুও মানুষ সুরক্ষিত থাকুক এটাই আমি চাই।’
জাতীয় পর্যায়ে মাতৃভাষার সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন ও বিকাশে অবদানের জন্য জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা সংরক্ষণে অবদানের জন্য খাগড়াছড়ির জাবারাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরাকে এ বছর পদক দেয়া হয়।
এ ছাড়া উজবেকিস্তানের ভাষা গবেষক ইসমাইলভ গুলাম মিরজায়েভিচ ও বলিভিয়ার প্রতিষ্ঠান দ্য এক্টিভিসমো লেংগুয়াজকেও এ বছর পদক দেয়া হয়।
অনুষ্ঠানে মাতৃভাষার জন্য শরীরের রক্ত ঢেলে দিয়ে যারা নজির স্থাপন করেছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান সরকার প্রধান।
তিনি বলেন, ‘যে কোনো একটি জাতির জন্য ভাষাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এবং মায়ের ভাষায় শিক্ষা নিতে গিয়ে বা মায়ের ভাষায় কথা বলে আমরা সহজে শিখতে পারি। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে যে ধীরে ধীরে অনেক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। তারপরেও সারা বিশ্বেই ভাষার যে বৈচিত্র্য রয়েছে তা সংরক্ষণ, বিকাশ এটা একান্তভাবে প্রয়োজন।’
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারির স্বীকৃতি আদায়ে ভূমিকা রাখায় কানাডা প্রবাসী সালাম ও রফিকের অবদান তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানে বলেন, ‘পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর স্বাধীনতার ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম মুছে ফেলার একটা প্রচেষ্টা করা হয়। ভাষা আন্দোলন যে তিনি শুরু করেছিলেন এবং সেখানে যে তার অবদান রয়েছে অনেক জ্ঞানীগুণীও তা মানতে চাইতেন না। তারা বলতেন, শেখ মুজিব তো জেলে ছিলেন তিনি আবার ভাষা আন্দোলন করলেন কীভাবে? জেলে তিনি গিয়েছিলেন কেন?’
তিনি বলেন, ‘তাকে তো গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তিনি ভাষা আন্দোলন শুরু করলেন এবং প্রচার শুরু করলেন। সে কারণে তিনি বারবার গ্রেপ্তার হন। তার যে দীর্ঘ সংগ্রাম। এরপর থেকে এই যে মুক্তির সংগ্রাম তিনিই তো করে গেছেন।’
১৯৯৬ সালে প্রথম দফায় ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদন সংগ্রহের কথা তুলে ধরেন তিনি। বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ‘৯৬ সালে যখন সরকার গঠন করি, ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের সব রিপোর্টগুলো সংগ্রহ করি এবং দীর্ঘ ২০টা বছর এটা নিয়ে কাজ করি। আমার সাথে ছিল আমার বন্ধু বেবি মওদুদ। এই রিপোর্টগুলো থেকে তথ্য নিয়ে প্রথমে ভাষা আন্দোলন নিয়ে একটা বক্তব্য দেই। সে সময় অনেকে আমার সমালোচনা করে আর্টিকেলও লিখেছিলেন, সেটাও আমার মনে আছে। কিন্তু সত্যকে কি কেউ মুছে ফেলতে পারে? পারে না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যদিও একজন নেতার বিরুদ্ধে লেখা ডকুমেন্ট। এখান থেকেই কিন্তু আমাদের ইতিহাসের অনেক সত্য বেড়িয়ে এসেছে। এই ইতিহাসগুলো আমি অনেকবার বক্তৃতায় বলেছি। আরও বলেছি তখন যখন সবাই অস্বীকার করত। এখন আর আমার বলার প্রয়োজন নাই, সবাই জানতেই পারবেন।’
ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘ সংগ্রামের কথাও উঠে আসে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘আমি এটুকু বলব, একটি ভাষা একটা মানুষের পরিচয় এবং এই পরিচয়টাই আমাদের সম্মান দেয়। এটা হলো বাস্তবতা যে, বাঙালিই প্রথম ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে।
‘আমাদের ভাষার উপর আঘাত এমনভাবে এসেছে… প্রথমে আসলো আরবি ভাষায় বাংলা লিখতে হবে। সেটাও আন্দোলন করে ঠেকানো হলো। পরে আসলো ল্যাটিন শব্দে বাংলা লিখতে হবে। আমাদের বাংলা শব্দে কী সমস্যা ছিলো জানি না। এটার জন্যও কিন্তু সংগ্রাম করতে হবে। এই সংগ্রামের পথ বেয়েই কিন্তু স্বাধীনতা এসেছে।’
বাংলাসহ পৃথিবীর সব মাতৃভাষা রক্ষার তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমাদের ইতিহাস আমাদের ঐতিহ্য রক্ষা করে, হ্যাঁ আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের অন্য ভাষা শিখতে হবে। সেই সাথে মাতৃভাষাটা আগে শিখতে হবে। সেই সঙ্গে আমাদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি তাদের ভাষাগুলোও আমাদের সংরক্ষণ করতে হবে। তাদের ভাষায় যেন শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে এজন্য আমরা যেমন বিনা পয়সায় বই দিই, আমরা তাদের বইগুলোও কিন্তু ছাপিয়ে বিনা পয়সায় দিয়ে দিচ্ছি। তারাও যেন নিজের ভাষা শিখতে পারে এবং ব্যবহার করতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘আজকে ভাষার অধিকার রক্ষা করা, ভাষাকে সম্মান দেয়া পৃথিবীর হারিয়ে যাওয়া ভাষাগুলি সংরক্ষণ করার জন্যই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আমি গড়ে তুলি। দ্বিতীয়বার সরকারে এসে এটার কাজ সম্পন্ন করি। সারা বিশ্বের হারিয়ে যাওয়া ও চলমান ভাষা এখানে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। যেহতু ২১ শে ফেব্রুয়ারি আমাদের অন্য ভাষাগুলিও যেন আমরা এখানে সংরক্ষণ করে সেগুলো যেন একেবারে হারিয়ে না যায়, সে ব্যবস্থাটাই আমরা নিয়েছি। এটা বাংলাদেশের জন্য একটা সম্মানজনক প্রতিষ্ঠান।’
এর আগে মাতৃভাষায় শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ করে দেয়ায় মারমা, চাকমা, ককবরক, গারো ও সাদরি ভাষায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান সেই ভাষাভাষি শিশুরা।