
বাংলাদেশে চালের কোনো সংকট নেই। পর্যাপ্ত। তবু বাড়ছে দাম। মজুতদাররা বাজারে না ছেড়ে চাল ধরে রাখছেন। এ কারণে দাম বাড়ছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
তবে বেসরকারিভাবে কার কাছে কত মজুত রয়েছে, তা অজানা।
এদিকে, আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে সরকারের চালের বাফার মজুতও।
বাজার থেকে প্রায় দেড় কেজি মোটা চালের আগের দাম দিয়ে এখন এক কেজি কেনাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
কৃষি শুমারি ২০০৮ অনুযায়ী, দেশে মোট পরিবার বা খানা সংখ্যা ২ কোটি ৮৬ লাখ ৯৫ হাজার ৭৬৩। এখানে ১ কোটি ৩৫ লাখ ১২ হাজার ৫৮০ পরিবার কৃষিবহির্ভূত। আর কৃষিকাজে যুক্ত এমন পরিবার এক কোটি ৫১ লাখ ৮৩ হাজার ১৮৩।
কৃষিতে যুক্ত অন্তত ৪৫-৫০ লাখ পরিবার ধান চাষ করলেও পরিবারের চাহিদা মেটাতে কিংবা অন্য ফসলে বিনিয়োগের অর্থের যোগান পেতে জমি থেকে ফসল তোলার পর তারা বাজার দামে বিক্রি করে দেয়। ফলে মৌসুম শেষে এসব পরিবারে মাস চলার মতো চাল থাকে না। তাদেরও বাজার থেকে চাল কিনে খেতে হয়।
মজুতের অদৃশ্য পকেট কারা?
জানা গেছে, অদৃশ্য পকেটের তালিকায় রয়েছে ৩ হাজার ৫০০ অটো রাইস মিল ও ১৮ হাজার ৫০০ রাইস মিল, যারা দেশে ধান-চালের বড় ক্রেতা ও সরবরাহকারী। এ ছাড়া চালের মজুত রয়েছে অন্তত ১৭ বড় করপোরেট কোম্পানির কাছেও, যারা গত কয়েক বছরে খাদ্যপণ্যের বাজারে প্রবেশ করেছে। তাদের অনেকে সরাসরি চালের ব্যবসার পাশাপাশি খাদ্যবহির্ভূত পণ্য তৈরি করছে, যার উপকরণ হিসেবে চালের প্রয়োজন হচ্ছে।
বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ব্রি) গবেষণা বলছে, প্রতিবছর দেশে উৎপাদিত চালের ২৪-২৬ শতাংশ এ বড় কোম্পানিগুলোর খাদ্যবহির্ভূত পণ্য তৈরির পেছনে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, নিয়মিত আড়তদার, ফড়িয়া, পাইকার ও খুচরা বিক্রেতা, এমনকি বড় মাপের কৃষকও ধান-চাল মজুত করেন।
এক শ্রেণির মৌসুমি ব্যবসায়ীও চাল মজুত করে। তারা উৎপাদন মৌসুমে লাখো টাকা বিনিয়োগ করে ধান-চাল কিনে নিজেদের সুবিধামতো জায়গায় মজুত রাখেন। পরে বাজারে দাম বাড়লে চাল ছাড়েন। তবে মিলারদের কাছে চালের পর্যাপ্ত মজুত নেই।
সরকার কী করছে
চাল মজুতের এসব অদৃশ্য পকেটের খবর সরকারের নীতিনির্ধারকেরা ভালো করেই জানেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারের মজুত কমেছে এটা সত্যি। তবে বেসরকারি খাতে নানা পকেটে চাল রয়েছে, সেই তথ্য সরকারের কাছে আছে। জানা গেছে, মজুতের পকেটগুলো মনিটর করা হচ্ছে।
মজুত ও সংরক্ষণ নীতিমালা অনুযায়ী, চাল সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠান ১৫ দিনে যে চাল উৎপাদন করবে, তার পাঁচ গুণ চাল তিন মাস পর্যন্ত মজুত রাখতে পারে। আগে এই নিয়ম বহাল থাকলেও এখন বাজার পরিস্থিতির কারণে সরবরাহ বাড়াতে এ নীতিমালা সংশোধন করে সরকার তা এক মাসে নামিয়ে এনেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মজুতদাররা কেউ নীতিমালার সংশোধনী মানছেন না। এমনকি কারা কোথায় কতদিন বা কত মাস চাল ধরে রাখছেন, তার তথ্যও সরকার সুনির্দিষ্টভাবে জানে না। তাছাড়া বেসরকারি খাতে হস্তক্ষেপে সরকারের আইনি সীমাবদ্ধতা আছে। দুর্বলতা আছে রাষ্ট্রীয় মজুত তলানিতে নামারও। কারণ বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের বড় অস্ত্র হচ্ছে বাফার মজুত। এসব কারণে সরকার মজুতদারির বিরুদ্ধে কঠোর হতে পারছে না। ফলে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে এখন চাল আমদানিতে যেতে হচ্ছে।
ধান-চাল উৎপাদনে সঠিক তথ্যের অভাব, অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের মজুত কমে যাওয়া ও বাজার ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর ভুল নীতির খেসারত দিচ্ছে ভোক্তারা। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো যার যার দায়িত্ব ঠিক সময়ে সঠিকভাবে পালন করলে দেশে চাল সংকটের সুযোগ তৈরি হতো না।
রাজস্ব কমে যাওয়ার আশঙ্কায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড করোনা পরিস্থিতিতে স্বপ্রণোদিত হয়ে ভোক্তা স্বার্থে শুল্ক কমানোর আগাম উদ্যোগ নেয়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এ বিষয়ক লিয়াজো পদক্ষেপে অনেক বিলম্ব ঘটে। আর চালসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে এ মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে তদারকি দুর্বলতার অভিযোগ রয়েছে। আবার আমদানির নিবন্ধন নিয়েও আমদানিকারকদের চাল আমদানিতে দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, সরকারি পর্যায়ে ভারত থেকে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে। ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে দেড় লাখ টন চাল দেশে আসবে। সে সঙ্গে বেসরকারি খাতেও ২৮টি প্রতিষ্ঠানকে আমদানির নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। সেই চাল আসা শুরু হয়েছে।
৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ৭৭ হাজার টন চালের এলসি খোলা হয়। আর নিস্পত্তি হয় ৬১ হাজার টনের। এখন নিয়মিত বিরতিতে চাল আসবে। এতে দামও তুলনামূলক কমবে।
সরকারের মজুত কমল কেন
২০২০ সালের ১৪ অক্টোবর দেশে খাদ্যশস্যের মোট মজুতের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৯৫ হাজার টন। এর মধ্যে চালের মজুত ছিল ৮ লাখ ৮৩ হাজার টন। তবে করোনা মহামারি ও কয়েক দফা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের খাদ্য সহায়তা দেয়ায় খাদ্যশস্য মজুত কমেছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় গেল বছরের ২৬ এপ্রিল থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মজুত বাড়াতে ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল কেনার লক্ষ্য নিলেও কিনতে পেরেছিল ৬ লাখ ৮০ হাজার টন। একইভাবে দেড় লাখ টন আতপ চাল কেনার লক্ষ নিয়ে কিনতে পারে ৯৯ হাজার টন। বোরো ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল ৮ লাখ টন। কিনতে পেরেছে মাত্র ২ লাখ ২০ হাজার টন, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৭২ দশমিক ৫ শতাংশ কম।
এই ধান চাল আকারে ধরা হলে অভিযান মৌসুমে সরকার মোট চাল সংগ্রহ করতে পারে ৮ লাখ ৩১ হাজার ৪৬১ টন। এর বাইরে ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট চাল আমদানি হয়েছে মাত্র ৪ হাজার টন। এসব মিলে চালের মজুত কিছুটা বাড়লেও তা গুদামে বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। অর্থাৎ সরকারের মজুত বিভিন্ন উন্নয়ন সহায়তার কারণে প্রতিনিয়ত কমতে থাকে।