
কোভিড-১৯ মহামারি দেশের স্বাস্থ্য ও অর্থ খাতসহ প্রায় সব খাতকেই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশে তামাকজাত পণ্যের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে জনস্বাস্থ্য আরও ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) তামাককে করোনা সংক্রমণের সহায়ক হিসেবে চিহ্নিত করে তামাক ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার কথা বলেছে।
ধূমপানের কারণে শ্বাসতন্ত্রের নানা রকম সংক্রমণ এবং শ্বাসজনিত রোগ তীব্র হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একাধিক গবেষণা পর্যালোচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, অধূমপায়ীদের তুলনায় ধূমপায়ীদের কোভিড-১৯ সংক্রমণে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। এছাড়া তামাক ব্যবহারের কারণে বিভিন্ন জটিল অসংক্রামক রোগ যেমন- হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। সার্বিকভাবে তামাক ব্যবহারের চিত্র অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
তামাকের সর্বগ্রাসী থাবায় জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশ আজ মারাত্মকভাবে ঝুঁকিগ্রস্ত। বিশ্বজুড়ে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর প্রধান আটটি কারণের মধ্যে ছয়টির সঙ্গেই তামাক জড়িত। তামাকের এই ভয়াল ক্ষতি প্রতিরোধে ২০০৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ সরকার জনস্বাস্থ্যের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এফসিটিসির আলোকে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০০৫ প্রণয়ন করে। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে তামাক আইনের গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনা হয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়।
এই আইন ও বিধিমালার উল্লেখযোগ্য দিকগুলো হলো- পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ, তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা নিষিদ্ধ, অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাছে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধ, তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্ক বার্তা মুদ্রণ নিশ্চিত করা।
তামাক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি এফসিটিসির সঙ্গে অনেকাংশে মিল থাকলেও কিছু কিছু জায়গায় দুর্বলতা রয়েছে। যেমন- তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা ৪(১) অনুসারে, কোনো ব্যক্তি কোনো পাবলিক প্লেস এবং গণপরিবহনে ধূমপান করতে পারবে না। কিন্তু বেশ কিছু ক্ষেত্রে পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহনে ধূমপানের অনুমতি দেয়া আছে। যেমনÑ চার দেয়ালে আবদ্ধ নয় এমন রেস্তোরাঁ, কোনো কোনো পাবলিক প্লেসে নির্ধারিত ধূমপান এলাকা, একাধিক কক্ষবিশিষ্ট গণপরিবহন, ট্রেন ও লঞ্চে নির্ধারিত স্থান, সব ধরনের অযান্ত্রিক পরিবহনে।
আইনের এই দুর্বলতাগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণে অনেক বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে অনেক হোটেল, রেস্তোরাঁ, কফিশপ ইত্যাদি রয়েছে যেগুলোর চারপাশ দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ নয়। সেসব জায়গাসহ সব ধরনের পাবলিক প্লেস, কর্মক্ষেত্র ও গণপরিবহনে ধূমপানসহ সব ধরনের তামাক গ্রহণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে।
বিদ্যমান আইনের ধারা-৫ এর উপধারা (১) এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে ‘তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার’ অর্থ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো তামাকজাত দ্রব্য বা তামাকের ব্যবহার প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে যেকোনো ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করা।
ধারা-৫ এর উপধারা (৩)-এ বলা আছে, তামাক কোম্পানি ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি’র অংশ হিসেবে সামাজিক কর্মকাণ্ডে আর্থিক বা অন্য যেকোনোভাবে অংশ নিতে পারবে। তবে প্রতিষ্ঠানের নাম, সাইনবোর্ড, ট্রেডমার্ক, প্রতীক ব্যবহার করতে পারবে না। কিন্তু বিদ্যমান আইনে বিক্রয় কেন্দ্রে ‘প্রোডাক্ট ডিসপ্লে’ নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই।
আইনের এই সীমাবদ্ধতা কাজে লাগিয়ে তামাক কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। আবার আইনে ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি’ বা সিএসআর নিষিদ্ধ নয়। এই সুযোগে নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করতে সিএসআরকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে তামাক কোম্পানিগুলো। তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধকরণের ক্ষেত্রে আইনের এই দুর্বলতা হলো একটি বাধা।
চলমান কোভিড-১৯ মহামারিতেও ব্যবসা অব্যাহত রাখতে তামাক কোম্পানিগুলো সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি (সিএসআর), লবিং, অনুদান ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচারসহ বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করেছে। সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাঠ প্রশাসনকে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী প্রদান, ইমেজ প্রচারের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ফেসবুক পেজে লাইভ টকশোতে অংশগ্রহণ করোনায় ধূমপায়ীদের ক্ষতি কম- এ ধরনের ভ্রান্ত তথ্য প্রচার অব্যাহত রেখেছে কোম্পানিগুলো।
তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধে বেশ কিছু দুর্বলতা রয়েছে। বর্তমান আইনে বিড়ি-সিগারেটের খুচরা শলাকা এবং ধোঁয়াবিহীন তামাকদ্রব্য খোলা বিক্রি সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। তথ্যপ্রমাণ থেকে দেখা গেছে, খুচরা শলাকা বিক্রি তরুণ সমাজ ও স্বল্প আয়ের মানুষদের ধূমপান সহজলভ্য করে। আর এই সহজলভ্যতা ধূমপানের আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়।
বিদ্যমান আইনে ই-সিগারেট ও হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টের মতো নতুন ধরনের তামাকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অথচ জনস্বাস্থ্য, কিশোর ও তরুণদের জন্য নতুন হুমকি ই-সিগারেটের মতো তামাকের নতুন ধরন। বাংলাদেশে ই-সিগারেট নিয়ে স্পষ্ট কোনো আইন না থাকায় সুলভ মূল্যে অহরহ ই-সিগারেট বাংলাদেশে আমদানি ও বিক্রয় করা হচ্ছে। সিগারেট কোম্পানিগুলো ই-সিগারেট কম ক্ষতিকর বলে তরুণদের উদ্বুদ্ধও করছে। তবে এরই মধ্যে ই-সিগারেটের ভয়াবহতা থেকে জনগণকে রক্ষার জন্য ভারতসহ বিশ্বের ৪২টি দেশে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ৫৬টি দেশ ই-সিগারেট ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে।
তামাকজাত দ্রব্য মোড়কজাতকরণের ক্ষেত্রে বর্তমান আইনে উল্লেখ করা আছে। ধারা-১০ এর উপধারা (১) অনুসারে তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট, মোড়ক, কাটুন বা কৌটার উভয় পাশে বা মূল্য প্রদর্শনী স্থলের উপরিভাগে ৫০ ভাগজুড়ে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সচিত্র সর্তকবাণী, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে বাংলায় মুদ্রণ করতে হবে। বর্তমান আইনে তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট, মোড়ক বা কৌটার আকার/আয়তন কেমন হবে এবং কী পরিমাণ তামাকজাত দ্রব্য থাকবে, তা বলা নেই। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো ধোঁয়াবিহীন তামাকদ্রব্য মোড়কবিহীন বা খোলা বাজারে বিক্রি করে। ফলে তাদের বিধিনিষেধের আওতায় আনা যায় না।
বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে যেসব ক্ষেত্রে সংশোধন দরকার, তার মধ্যে রয়েছে সব ধরনের গণপরিবহন ও পাবলিক প্লেসে তামাক ব্যবহার শতভাগ নিষিদ্ধ করা, দোকানে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা, তামাক কোম্পানির সিএসআর নিষিদ্ধ করা, ই-সিগারেট আমদানি, উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা, তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কের আকার নির্ধারণ করে দেয়া এবং তামাকদ্রব্যের খুচরা বিক্রি নিষিদ্ধ করা।
তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার সুযোগ থাকায় সরকারের নীতিপ্রণেতাদের সঙ্গে অপ্রয়াজনীয় যোগাযোগ তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তামাক কোম্পানিগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক নীতি গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দুই বছর পর পর বিশ্বব্যাপী তামাক ব্যবহারের ব্যাপকতা নিয়ে রিপোর্ট অন গ্লোবাল টোব্যাকো এপিডেমিক (জিটিসিআর) প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশে এফসিটিসির মূলনীতিগুলোর অনুবর্তিতা তুলে ধরা হয়। ২০১৯ সালে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ এবং তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে এখনো সর্বোত্তম মান অর্জন করতে পারেনি।
২০১৬ সালে ৩১ জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় স্পিকার্স সম্মেলনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দেন। এজন্য তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ও এফসিটিসির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে সংশোধনের ঘোষণাও দেন। বিদ্যমান আইনের দুর্বলতা সংশোধন করতে পারলেই প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাটি বাস্তবায়ন সম্ভব, যা জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হ্রাসে ভ‚মিকা রাখার পাশাপাশি ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সহায়ক হবে।
সুতরাং তামাকের নেতিবাচক প্রভাব থেকে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এফসিটিসির আলোকে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করার মাধ্যমে তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং অন্যান্য যুগোপযোগী আইন পাস করা এখন সময়ের দাবি। এতে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা হবে।
লেখক: হোসেন শাহাদাত/ সাব-এডিটর, সময় পূর্বপার