প্রকাশিত সংখ্যাপ্রধান প্রতিবেদনবিনোদন ভুবন

দারিয়ুস মেহেরজুঁইয়ের ‘দ্য কাউ’ সামাজিক মেলবন্ধনের ছবি

দারিয়ুস মেহেরজুঁই ইরানি চলচ্চিত্রের অগ্রপথিক। ১৯৩৫ সালের ৮ ডিসেম্বর তেহরানের এক মধ্যবিত্ত ঘরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। শুরুতে মিউজিক এবং চিত্রকলার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল দারিয়ুসের। সেই আগ্রহ থেকে তিনি চমৎকার সান্তুর ও পিয়ানো বাজানো শেখেন। ধীরে ধীরে তৈরি হয় সিনেমা দেখার প্রতি প্রবল আগ্রহ। সারা দিন সিনেমা দেখায় মত্ত থাকতেন তিনি। তাঁর ভালো লাগত আমেরিকান সিনেমা। ইংরেজি খুব একটা বুঝতেন না বলে ডাবিংয়ে দেখতেন। কিন্তু তাঁর মনে হতো ডাবিংয়ে চলচ্চিত্রের মূল সুরটা কেটে যায়। সিনেমা দেখার জন্য ইংরেজি শেখা শুরু করেন দারিয়ুস। সেই সময়ই ইতালিয়ান নির্মাতা ভিত্তুরি দ্য সিকার ছবি ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’ দেখে প্রবল আলোড়িত হন। নির্মাতা হওয়ার স্বপ্ন মাথায় চেপে বসে। তিনি তখন মাত্র ১২ বছর বয়সী একটা ছেলে। একটা সিনেমা যে একজন শিশুকে এতটা আলোড়িত করতে পারে, এটা নাকি মেহেরজুঁই স্বয়ং বুঝতে পারেননি। আর এর থেকেই ভেতরে ভেতরে দানা বেঁধে ওঠে নির্মাতা হওয়ার বাসনা।
এর বছর কয়েক পর তিনি আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন । পড়াশোনা করেন ফিল্ম বিভাগ নিয়েই। সেখানেই সিনেমার হাতেখড়ি হয় মেহেরজুঁইয়ের। কীভাবে সিনেমা বানাতে হয়, কীভাবে ক্যামেরা চালাতে হয়, সাদামাটা একজন অভিনেতার কাছ থেকে কীভাবে সত্যিকারের অভিনয়টা আদায় করতে হয়, সবই বুঝেন, শোনেন, জানেন। আর এই কাজে তাঁকে পূর্ণ সহযোগিতা করেন বিখ্যাত ফরাসি নির্মাতা জ্যাঁ রেনোয়াঁ।
সত্তরের শুরুতে তিনি দেশে ফিরে আসেন। এসে দুই বছর তেহরানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি ভাষা ও সাহিত্য পড়াতেন। এরপর হাত দেন নির্মাণের কাজে। ১৯৬৬ সালে প্রথমবারের মতো নির্মাণ করেন ‘ডায়মন্ড ৩৩’। ১২০ মিনিটের এই ছবিটি খুব একটা সাড়া ফেলতে পারেনি। তবে তাঁর দ্বিতীয় ছবি ‘গাব’ (দ্য কাউ) ইরানি চলচ্চিত্রে প্রথমবারের মতো একটা প্রবল ধাক্কা দেয়। সেই সাথে বিশ্ব সিনেমায়ও দারুণ প্রভাব ফেলে। এই ছবিটি তাঁকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে একজন নির্মাতা হিসেবে পরিচিতি এনে দেয়। শুধু তাই-ই না, ছবিটির এই ধারা ইরানি চলচ্চিত্রে ‘নিউ ওয়েব’কে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে যায়। সমৃদ্ধ করে ইরানি ছবির জগৎ। তাঁর দেখাদেখি উদ্বুদ্ধ হন আরও বেশ ক’জন তরুণ নির্মাতা। অন্যদিকে মেহেরজুঁই একে একে নির্মাণ করতে থাকেন দ্য পোস্টম্যান, দ্য সাইকেল, হামুন, দ্য লেডি, সারা, পারি, লায়লা, টু স্টে এলাইভ , সান্তুরি, গুড টু বি ব্যাক এবং সর্বশেষ তিনি নির্মাণ করেন ‘ঘোস্ট’ নামের একটি চলচ্চিত্র।

ছবি: সময় পূর্বাপর


দারিয়ুস মেহেরজুঁই তাঁর ছবি নিয়ে নতুন নতুন এক্সপেরিমেন্টে যান যা ওই সময়ে আর কারো মধ্যে দেখা যায়নি। দ্য কাউ তেমনই একটি এক্সপেরিমেন্ট। তাছাড়া বেশির ভাগ সময় তিনি দেশি-বিদেশি উপন্যাস থেকে চিত্রনাট্য তৈরি করে সিনেমা করতে বেশি আগ্রহী ছিলেন। সেটাও ইরানি নির্মাতাদের মধ্যে এর আগে খুব একটা লক্ষণীয় ছিল না।
‘দ্য কাউ’ দারিয়ুস মেহরজুইয়ের পরিচালনায় ১৯৬৯ সালের ইরানি ছবি। এটি ইরানের একটি ক্ল্যাসিক চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটি নানা কারণে বিখ্যাত। গোলাম হোসেন সাঈদীর উপন্যাস ও চিত্রনাট্যে ছবিটির নাম ভ‚মিকায় অভিনয় করেছিলেন ইজ্জাতোলাহ এনতেজামি। ১৯৬৪ সালে ইরানি সিনেমা শিল্পে যে নববিপ্লবের সূত্রপাত ঘটেছিল, ‘দ্য কাউ’ তার প্রথম দিকের প্রতিনিধি।
১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব ঘটার পর সিনেমা শিল্পে কঠোর সেন্সরশিপ শুরু হয়। সে কারণে ইরানি সিনেমা শিল্প সংকুচিত হয়ে পড়ার আশঙ্কায় জর্জরিত হয়ে পড়ে। সে সময় ‘দ্য কাউ’ রাষ্ট্রীয় চিন্তক ও নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিগোচর হয়। সব সন্দেহকে পরাভ‚ত করে সিনেমাশিল্প বিকাশের এক নতুন পথ উন্মোচন করে দ্য কাউ। আজকের বিশ্বে ইরানি চলচ্চিত্রের গৌরবোজ্জ্বল অবস্থানের ভিত্তিভ‚মি নির্মাণে ‘দ্য কাউ’-এর ভ‚মিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
‘দ্য কাউ (গাভ)’ চলচ্চিত্রের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে গ্রামীণ মধ্যবয়সী হাসান ও তার পালিত গরুকে কেন্দ্র করে। হাসান বিবাহিত ও নিঃসন্তান। তার একটি গরু আছে। গরুটি তার প্রাণাধিক প্রিয়। গরুটি গাভীন। সে গরুটিকে নিজ হাতে খড়কুটো খাওয়ায়। গোসল করায়। এমনকি গরুর সাথেই নানা রকম খেলাধুলা করে আমোদ-আহ্লাদে মেতে থাকে।
তাদের গ্রামে গরু চোরের উৎপাত আছে। চোর গরু নিয়ে যেতে পারে এই ভয়ে সে গরুর সাথে গোয়াল ঘরে রাতও কাটায়। অতন্দ্র প্রহরীর মতো সে জেগে গরু পাহারা দেয়। যদি কখনো ঘুমিয়েও পড়ে রাতে সামান্য আওয়াজ হলেও তার ঘুম ভেঙে যায়। সে উঠে চারপাশ দেখে তবেই নিশ্চিন্ত হয়। একবার বিশেষ কারণে এক দিনের জন্য গ্রামের বাইরে যায় হাসান। এই সময়ে তার প্রিয় গরুটি কি এক অজানা কারণে মারা যায়। হাসানের স্ত্রীর আর্তচিৎকার ও কান্নায় পাড়ার লোকেরা ছুটে আসে। তারা এই ভেবে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে যে, হাসান কী করে এত বড় শোক সামলাবে। গরুটির মৃত্যুসংবাদ তাকে কি করে দেবে এবং দিলে তার প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে অথবা সে এই শোক সহ্য করতে পারবে কিনা, এ নিয়ে গ্রামবাসীরা মহাদুশ্চিন্তায় পড়েন! বিষয়টি নিয়ে গ্রামপ্রধানসহ পাড়ার মানুষের মধ্যে আলোচনা হয়। অনেক আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়, হাসান এলে বলা হবে, গরুটি হারিয়ে গেছে এবং খোঁজার জন্য লোক লাগানো হয়েছে। সবাই মিলে বাড়ির উঠোনে গর্ত করে মৃত গাভীন গরুটিকে পুঁতে দেয়। পরের দিন হাসান আসে। পাড়ার লোকেরা খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে। একসময় হাসান জানতে পারে যে, তার গরুটি নেই। সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। হাসান বিশ্বাস করতে শুরু করে হারিয়ে যাওয়া গরুটি সে নিজে। নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে গোয়ালঘরেই দিন কাটে তার। গরুর মতোই খড়কুটো খেতে শুরু করে। পাড়ার ধর্মীয় বিশ্বাস মোতাবেক হাসানের চিকিৎসা করানো হয়, কিন্তু কিছু না হওয়ায় গ্রামপ্রধানসহ সিদ্ধান্ত হয় হাসানকে চিকিৎসার জন্য শহরের হাসপাতালে নিতে হবে। হাসপাতালে নেয়ার জন্য নানাভাবে তাকে বোঝানো হয়। কোনোভাবেই রাজি না হওয়ায় গরুর মতো বেঁধে টেনে হিঁচড়ে হাসানকে হাসপাতালের পথে নিতে থাকে গ্রামবাসী। টেনে হিঁচড়ে নেয়ার সময় যখন কিছুতেই শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারে না তখন নিজেদের অজান্তেই তারা গরু খেদানোর মতো করে আঘাত করতে থাকে হাসানকে। হঠাৎ তারা সম্বিত ফিরে পায় এবং ভীষণ অসহায় বোধ করে। হাসানের জন্য মায়া হয়। গ্রামবাসীরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। অকস্মাৎ হাসান গরু ছোটার মতো হাত থেকে ছুটে যায় এবং পাহাড়ের ওপর থেকে পড়ে মারা যায়।
এই হলো দারিয়ুস মেহরজুঁইয়ের ‘দ্য কাউ’ সিনেমার কাহিনি। সিনেমাটির কাহিনিতে হাসান ও তার গরু মূল উপজীব্য হলেও উঠে এসেছে সমকালীন সমাজ এবং সামাজিক জীবনাচার। সমাজে বিদ্যমান ধর্মীয় বিশ্বাস, রীতিনীতি, অভ্যাস ও আচার-আচরণের এক অপূর্ব জীবনালেখ্য দ্য কাউ। পুরোটা সিনেমায় একটি ছোট্ট গ্রাম ও গ্রামের মানুষের পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি সবকিছুকে ছাপিয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে। গ্রামের একমাত্র শত্রæ চোরের উপদ্রব ঠেকানোর জন্য গ্রামের মানুষ সংঘবদ্ধ হয়। এ দৃশ্যগুলো চিরায়ত গ্রামীণ ঐক্য ও অকৃত্রিম সম্প্রীতির এক চমৎকার চিত্র তুলে ধরে। হাসানের অবর্তমানে তার গরুর করুণ মৃত্যু এবং গ্রামের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষের হাসানকে নিয়ে উদ্বিগ্নতায় গ্রামীণ সমাজের পারস্পরিক মমত্ববোধের চিরাচরিত রূপ দৃশ্যমান হয়। এ যেন গ্রাম নয়, সমস্ত গ্রাম মিলেই একটি পরিবার।
ছবিটি নির্মাণে কোনো বাহুল্য নেই। সহজ-সরল সাদামাটাভাবেই গল্পটি উপস্থাপন করা হয়েছে। সমস্ত চরিত্রই বাস্তব। হাসানের নিজেকে গরু ভাবা, গোয়ালে বাস করা, ঘাস খাওয়ানোর মাধ্যমে চিত্রনাট্যকার চলচ্চিত্রে পরাবাস্তবতার অনুষঙ্গ প্রবেশ করালেও গল্প ছাপিয়ে সময় ও পারিপার্শ্বিকতাই প্রধান হয়ে উঠেছে। আজকের আধুনিক জীবনের অবক্ষয়, সম্পর্কহীনতার পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে বদলে যাওয়া গ্রামের প্রেক্ষাপটে এ চলচ্চিত্রকে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে পারে। কিন্তু সমাজ বিনির্মাণে এবং মূল্যবোধের উদ্বোধনে এ ধরনের চলচ্চিত্র জরুরি। তাছাড়া এটাও বিবেচনায় নিতে হবে যে, এটি ষাটের দশকের চলচ্চিত্র। শুধু কাহিনি নয়, প্রযুক্তিরও সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব ছিল না তখন। গল্প বলার এমন সরল পদ্ধতি খুব কম চলচ্চিত্রেই দেখা যায়। ছবিটির বিষয় আমার দৃষ্টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ইতিবাচকতা সবসময়ই প্রয়োজন। তাছাড়া ছবির কাহিনিও বাস্তব, খাপছাড়া নয়। একজন নিঃসন্তান মানুষের কাছে তার গরুটি সন্তানতুল্য হতেই পারে।
চলচ্চিত্র সমাজ বদলের অন্যতম হাতিয়ার। মানুষের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ, সম্প্রীতি রক্ষা ও তা নতুন করে তৈরিতে চলচ্চিত্রের প্রভাব অপরিসীম। চলচ্চিত্রের শক্তিও অনেক। এটা একসাথে দেখা, শোনা ও অনুধাবন করা যায় বলে বোধের দরজায় সরাসরি কড়া নাড়তে পারে। আজকের বিশ্বে মূল্যবোধের অবক্ষয়, অস্তিত্বের সংকট, পারিবারিক ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা দূরীভ‚ত করার জন্য ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ যেমন আবশ্যক, তেমনি সংকট সৃষ্টি করে এমন নাটক কিংবা চলচ্চিত্র নির্মাণ থেকে বিরত থাকাও জরুরি।
এখন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব মানেই ইরানি ছবির ফুলঝুরি। অথচ একটা সময় ইরানি ছবির মান উপমহাদেশীয় ছবির থেকেও খারাপ ছিল।
ইরানি চলচ্চিত্রের মোড় যাঁরা ঘুরিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের পথিকৃৎ দারিয়ুস মেহেরজুঁই। আজ ইরানি চলচ্চিত্রের চাকা ঘুরে চলেছে প্রতিনিয়ত। রঙ ছড়াচ্ছে পুরো বিশ্বের তাবৎ সব চলচ্চিত্র উৎসবে। বিশ্বের বাঘা বাঘা নির্মাতা, অভিনেতা আর সিনেমাটোগ্রাফারদের সাথে টেক্কা দিয়ে ছিনিয়ে আনছে সেরার পুরস্কার। এই পথ নির্মাণ করা মানুষদের একজন দারিয়ুস মেহেরজুঁই। মহসিন মাখমালবফ, আব্বাস কিয়ারোস্তামি, দারিয়ুস মেহেরজুঁইয়ের মতো কিছু অসাধারণ নির্মাতার ছোঁয়ায় বদলে গেল পুরো ইরানি সিনেমা।
শুধু ইরানি চলচ্চিত্র নয়, বিশ্ব চলচ্চিত্রের এই গুণী নির্মাতা দারিয়ুস মেহেরজুঁই ৮০ বছর বয়সেও নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন নতুন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে।

লেখক: আফরোজা পারভীন/ গল্পকার

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button