অবশেষে শেষ দানে এসে তাহলে ইউরোকে টেক্কা দিতে পারল লাতিন আমেরিকান ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের টুর্নামেন্ট কোপা আমেরিকা। এক মাস ধরে রেললাইনের মতো সমান্তরালে চলেছে ইউরো আর কোপা আমেরিকা। তবে সেখানে সম্প্রচার সৌন্দর্য থেকে শুরু করে ম্যাচের উত্তেজনা, মাঠের অবস্থা, রেফারিংয়ের মান, সময়ের পার্থক্য, দর্শক আগ্রহ- এমন কোনো দিক নেই, যেখানে ঢের কোপা আমেরিকার চেয়ে ইউরো এগিয়ে ছিল না। কিন্তু শেষ বেলায় এসে ১৮০ ডিগ্রি বদল।
ইউরোর ডামাডোলের মধ্যেও আন্তর্জাতিক ফুটবল বিশ্বের কাছে লাতিন আমেরিকার ফুটবলের বিজ্ঞাপন হওয়ার মতো ম্যাচ তো একটাই। আর্জেন্টিনা বনাম ব্রাজিল! এক দলে সময়ের অন্যতম সেরা ফুটবলার মেসি, অন্য দলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলো ছড়ানো নেইমার। মেসি কিংবা নেইমারÑ দুজনেরই ছিল জাতীয় দলের হয়ে বড় কোনো শিরোপা জিততে না পারার আক্ষেপ ঘোচানোর ঐতিহাসিক ম্যাচ। কিন্তু ব্রাজিলের ফুটবলতীর্থ মারাকানায় নেইমারের স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল। স্বপ্ন পূরণ হয়েছে মেসির, ঘুচিয়েছেন জাতীয় দলের হয়ে দীর্ঘ ১৬ বছর ক্যারিয়ারের শিরোপা না জেতার আক্ষেপ। তা-ও আবার চিরপ্রতিদ্ব›দ্বী ব্রাজিলকে হারিয়ে, ব্রাজিলেরই মাঠে।
সময়টা ২০১৬, কোপা আমেরিকার ফাইনালে চিলির বিরুদ্ধে হার লিওর আর্জেন্টিনার। রাগে-অভিমানে জাতীয় দলের হয়ে আর না খেলার ঘোষণা দেন আধুনিক ফুটবলের রাজপুত্র লিওনেল মেসি। যদিও আবার দ্রুতই ফিরে এসেছেন, পরবর্তীতে আর্জেন্টিনার অধিনায়কের দায়িত্ব নেন তিনি। বহু ইতিহাসের সাক্ষী মারাকানা ২০১৪ বিশ্বকাপে মেসিকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিলেও ২০২১-এ এসে আর হতাশ করেননি। ব্রাজিলকে হারিয়ে দীর্ঘ ২৮ বছর পর আন্তর্জাতিক শিরোপা জিতল আর্জেন্টিনা। মেসি পেলেন প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক শিরোপা জয়ের স্বাদ।
ডি মারিয়ার করা একমাত্র গোলে কোপা আমেরিকার ফাইনালে লিড নেয় আর্জেন্টিনা। ম্যাচে ব্রাজিল নিজেদের দখলে ৫৯ শতাংশ বল রেখেও বারবার গোল দেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। কোপা আমেরিকার আগে যে রক্ষণভাগ নিয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছিল, সে রক্ষণভাগই আর্জেন্টিনাকে কোপার শিরোপা জিতিয়েছে। দ্বিতীয়ার্ধে দাপুটে খেলেও ব্রাজিল পারেনি আর্জেন্টিনার রক্ষণভাগের তালা খুলতে। ম্যাচের ২১ মিনিটে রদ্রিগো দি পলের দেয়া লং বল থেকে ডি মারিয়া নিখুঁতভাবে ব্রাজিলের গোলকিপার এডারসনের মাথার ওপর দিয়ে বল জালে পাঠিয়ে দেন। আর সেই গোলই ম্যাচের ব্যবধান গড়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত তারা ১-০ গোলে এগিয়ে থেকে জয় নিশ্চিত করে।
লিও কিংবদন্তি উপাধি পেয়েছেন আগেই। চ্যাম্পিন্স লিগ, ব্যালন ডি অর, ফিফা বর্ষসেরা- ক্লাব আর ব্যক্তিগত ক্যারিয়ারে সবকিছু জিতেছেন তিনি। চাঁদের যেমন কলঙ্ক থাকে, তেমনই কলঙ্ক এই মেসির ক্যারিয়ারে। এবার সেই কলঙ্ক হয়তো কিছুটা হলেও মুছতে পেরেছেন। কোপা আমেরিকার ট্রফি, টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার এবং সেরা গোলদাতার পুরস্কারÑ পুরো কোপা আমেরিকা যেন নিজের করে নিয়েছেন মেসি। তৃপ্ত মেসি বলেছেন, ‘আমার মনে হয় ঈশ্বর এমন একটা মুহূর্ত আমার জন্যই বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। ব্রাজিলের বিপক্ষে ফাইনাল জেতা, তা-ও তাদেরই দেশে।’
এদিকে ইতালির গল্পটা আর্জেন্টিনা কিংবা মেসির মতো না হলেও কাছাকাছি বটে। তবে ইউরো জয়ের অপেক্ষাটা এক-দুই দিনের নয়, দীর্ঘ ৫৩ বছরের। ১৯৬৮ সালে প্রথমবারের মতো ইউরো জেতার পর সেই যে খরা শুরু হয়েছিল ইতালির, প্রজন্মের পর প্রজন্ম গেল। কিন্তু সেই মহেন্দ্রক্ষণ এলো না। গোলকিপার দোন্নারুম্মার বীরত্বে ইউরোর ইতিহাসে প্রথম ফাইনাল খেলা ইংল্যান্ডকে হারিয়ে সেই খরা কাটল মানচিনির দল। আবারও অধরাই রয়ে গেল ফুটবলকে ঘরে ফেরানোর ইংলিশ-স্বপ্ন। বরং ট্রফি হোমে নয়, গেল রোমে।
‘ইটস কামিং হোম’ গানের তালে তালে ইংল্যান্ডের শুরুটা ছিল দুর্দান্ত। ম্যাচ শুরুর ২ মিনিটের মধ্যেই প্রতিপক্ষের জালে বল পাঠান ইংলিশরা। এত কম সময়ে ইউরো ফাইনাল এর আগে কোনো গোল দেখেনি। এই শেষ, তারপর ইতালির আক্রমণের তোপে পথ হারিয়ে ফেলে হ্যারি ক্যানের ইংলিশরা। পুরো ম্যাচে ৬৬ শতাংশ বল দখলে রাখা মানচিনির দল সমতায় ফেরে দুর্দান্তভাবেই। নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময়ে ১-১ গোলে সমতায় ছিল ইতালি-ইংল্যান্ড। ম্যাচ গড়ায় ট্রাইব্রেকারে। শেষ পর্যন্ত বুকায়ো সাকার শেষ কিকটি ঠেকিয়ে নায়ক বনে গেলেন ইতালি গোলরক্ষক দোন্নারুম্মা। উত্তেজনায় ঠাসা ফুটবলতীর্থ লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ছিল প্রায় ৬৭ হাজার দর্শক, যাদের অধিকাংশ গলা ফাটিয়েছেন ইংল্যান্ডের হয়ে, তাদেরকে স্তব্ধ করে ৩-২ গোলে জিতে চ্যাম্পিয়ন হলো ইতালি। এর মাধ্যমে বড় শিরোপা জয়ের অপেক্ষা বাড়ল ইংল্যান্ডের, সঙ্গে বাড়ল ফুটবল ঘরে ফেরানোর স্বপ্ন।
অথচ এ ইতালি ২০১৭ সালের ১৩ নভেম্বর মিলানে সুইডেনের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করে ও দুই লেগ মিলিয়ে হেরে বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব উতরাতে ব্যর্থ হয়। ইতালিয়ান ফুটবলের সূর্য যেন অস্তমিত হয়েছিল ওই দিনই। চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম পরাশক্তি, আর তারাই কিনা ৩২ দলের ফুটবল বিশ্বকাপে জায়গা করে নিতে পারল না। সময়টাকে বলা হচ্ছিল, ইতালিয়ান ফুটবলের অন্ধকারতম অধ্যায়। তিন বছরের কম সময়ের ব্যবধানে সেই ইতালি এখন ইউরো জয় করেছে। আর অনেক ইতিহাসের সাক্ষী ওয়েম্বলিতে রচিত হলো ইতালিয়ান ফুটবরের নতুন গৌরবগাথা।
তবে এই বদল আসে ২০১৮ সালের মে মাসে দায়িত্ব নেয়া রর্বেতো মানচিনির হাত ধরেই। সেই যে শুরু, আর থামাথামি নেই। রেকর্ড অপরাজেয় যাত্রায় ইতালি এখন ইউরো সেরা। ইউরো ট্রফি জয়ের পর ইতালি কোচ বলেন, ‘একটা চক্র পূরণ হলো, তিন বছরের চক্র।’
সুইডেনের সঙ্গে ড্র করে নিজেদের দর্শকদের দুয়ো শুনে যেদিন মাঠ ছাড়তে হয়েছিল, সেদিন মুখ লুকানোদের দলে ছিলেন লিওনার্দো বোনুচ্চি। এখন তিনিই নায়ক। ফাইনালে ইতালিকে সমতায় ফেরানো গোল তার। পরে টাইব্রেকারেও খুঁজে নেন জাল। টাইব্রেকার শেষ হতেই, যখন থেমে গেছে স্বাগতিক দর্শকদের ‘ইটস কামিং হোম’ গর্জন। তখন ক্যামেরার সামনে মুখ এনে বোনুচ্চি চিৎকার করছিলেন, ‘ইটস কামিং টু রোম।’
আর্জেন্টিনার দীর্ঘ ২৮ বছরের অপেক্ষার অবসান, আর ইতালির অবসান হলো ৫৩ বছরের। এবারের কোপা আমেরিকা আর ইউরো যেন শাপমুক্তির পক্ষে। একদিকে মারাকানায় মেসির স্বস্তি, অন্যদিকে ওয়েম্বলিতে ইতালির বদলের নায়ক মানচিনির স্বপ্ন পূরণ। কিন্তু মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের এই মুকুট মাথায় পরে কি মেসির বিশ্ব জয় করতে না পারার আক্ষেপ মিটবে? কিংবা ২০১৮ বিশ্বকাপ’র চুড়ান্ত পর্বে জায়গা করতে না পারা ইউরো জয় করা ইতালি কী আগামী বিশ্বকাপের বার্তা হয়ে থাকছে না?
লেখক: হোসেন শাহাদাত/ সাব-এডিটর, সময় পূর্বপার