‘বন্ধ করে দাও মোড়ের লাল-হলুদ সিগন্যাল/ সতর্ক শকুনের চোখে শস্যের ধুলা পড়ুক অবিরত/ ফাঁকা রাস্তায় বীরদর্পে হেঁটে যাক বুনো-ভালোবাসা।’ (জলজ্যোৎস্নায় ভেজা একটি কবিতা)।
‘আমার করতলে হাঁটে তরুণ!/ আজ আমার সমস্ত ডালপালায়/ বৃষ্টি শেষের সতেজ গন্ধ/ আমাকে ফেরাতে পারবে না অব্যর্থ শকুন- তার স্থির নষ্ট চোখ।/ আমার ভিতরে শুধু বাউল বসন্তই জাগেনি,/ জেগেছে পঁচিশটি দেশলাই-কাঠির অভিজ্ঞতা,/ এবং তার মায়াময় লাবণ্য আগুন।’ (পঁচিশটি মায়াময় দেশলাই কাঠি)।
‘যে গ্রামে শহর থাকে, তাই আধুনিক গ্রাম/ আমাদের গ্রামের ভেতর ঢুকে গেছে শহর।/ এখন কিছু শহুরে পাজেরো, হারভেস্টার এবং/ কৃষিজীবী আর বাউল শিল্পী লতিফ শাহ/ গানে মাতে দীঘির হাওয়ায়- একসাথে ঘোর পূর্ণিমায়!!’ (আমাদের গ্রামের ভেতর)।
ঠিক এই রকমই কবি হাসান কল্লোলের ‘পাখি জীবন ও আমার ঘুমগাছ’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো। কবিতাগুলো ছোটগল্পের মতো অথবা অন্য রকম কবিতার মতো। কবিতাগুলো একেবারে শুরু থেকে ভালো লাগতে শুরু করে মাঝপথ হয়ে শেষ পর্যন্ত যে ভালো লাগে বা পুরো কবিতাটি পড়ে একটি সারসংক্ষেপ নিয়ে ওঠা যায়, অনেক কবিতায় কিন্তু এমনটি হয় না। কিন্তু বেশির ভাগ কবিতায় একটি টোকা এমনভাবে উপস্থিত যে, কবিতাটি প্রথম থেকে পড়ে আসতে হয়। সবগুলো কবিতা একবার পড়ে আবার শুরু থেকে পড়লে দেখা যায়, অধিকাংশ কবিতায় গীত কবিতার ব্রিজ লাইনের মতো একটা চুম্বকাংশ আঁকা আছে, যা পাঠককে ধুপ করে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বিশেষ ভালো লাগায় মনোযোগী করে ও কাব্যস্বাদে তৃপ্ত করে। বিশেষ ব্যঞ্জনায় এমন চরণ আরও আছে। ‘পাখির জীবনের সাথে’ কবিতাটিতে আছে, ‘আমার জীবন আমি এইসব/ পাখি জীবনের সাথে বদলে নিতে চাই।’ ‘যুবতী মাঠ’ কবিতায় আছে, ‘ও মাঠ, অবসরে কচি ঘাসের শাড়ি পরে/ তুমি শুধু দিনমান যুবতী হয়ে থেকো!’ বাংলা সাহিত্যের কাব্যধারায় এমন উল্লেখ বা রচন পদ্ধতি বা কৌশল আগেও দেখেছি; হাসান কল্লোলের কবিতায় অনেক দিন পর আবার দেখলাম।
‘পাখি জীবন ও আমার ঘুমগাছ’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাসব গদ্যঢঙে লেখা। ভাষা সহজ। বক্তব্য স্পষ্ট। ভণিতা বা অতিভাক্সময়তার অতিপ্যাঁচ নেই। ঝরঝরে ভাবটি কবিতাগুলো আরাম করে পড়তে সাহায্য করে। শব্দের কাঠিন্যহীনতা কবির ইশারা বুঝিয়ে দেয়। ‘বুঝ’ শব্দটির সাথে ‘কবিতা’ শব্দটির সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত- কেননা, বুঝ যদি পরিষ্কার না হয়, কবিতার মর্ম হারিয়ে যায়। তখন তা কবিতা হয়ে উঠলেও পাঠকের কাছে আর কবিতা থাকে না। পাঠক তখনই তাকে কবিতা বলে, যখন সে তা ধরতে পারে। প্রতীকটা নিজের ভেতর বহন করতে পারে। চলমানে হোক আর ভবিষ্যতে হোক বুঝের সাথে কবিতার সার্থকতা নিহিত। পাঠক না বোঝা পর্যন্ত তা কখনো কবিতা না, যতই তা কবিতা হোক। নির্দ্বিধায় বলতে পারি, ‘পাখি জীবন ও আামর ঘুমগাছ’-এর বায়ান্নটি কবিতাই বোধগম্য। একটি কাব্যগ্রন্থে আশ্রিত সব কবিতা একই সঙ্গে পাঠকের ভালো না-ও লাগতে পারে, এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু অনেকগুলো কবিতা বেশ মনে রাখার মতো। অনেকগুলো কবিতা ভালো লাগাকে স্পর্শ করে। অনেকগুলো কবিতার লাইট-লাইন ইচ্ছে করে নোট করে রাখতে। আবার অনেকগুলো কবিতায় বিষয়কে অধিক প্রাধান্য দিতে গিয়ে যে কবিতার কাব্যগুণ গৌন হয়েছে, সেটাও সত্য। একই গ্রন্থে ঘুরে ফিরে একই বিষয় বারবার আসায় কিঞ্চিৎ এককেন্দ্রিকতায় আচ্ছন্নও মনে হয়েছে, যা একজন কবির বেলায় প্রত্যাশিত নয়।
লক্ষ্য করা যায়, কবি হাসান কল্লোল সময় সম্পর্কে সচেতন। অতীত ও ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তিত। কবিতায় কালের প্রতি মগ্নতা, পরের দিনের ভাবনা তাকে নিমগ্ন কবি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দেশ, দেশপ্রেমও তাকে আঁকড়ে রেখেছে কবিসত্তার উজানে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করলে কোনো কবিতায় তাকে দেখা যায় তারুণ্যের প্রতীক হিসেবে, কোনো কবিতায় স্মৃতিকাতর হিসেবে, কোনো কবিতায় রক্তক্ষয়ী সময়ের প্রতি ব্যথিত হিসেবে, কোনো কবিতায় সম্ভাবনার প্রতি স্বাপ্নিক হিসেবে।
‘এই গাঁয়ে একদিন ঝরেছিল রুপালি বৃষ্টি/ বৃষ্টিতে ভিজেছিল পদ্মার মাঝি-/ ভিজেছিল আলক্ষেত, কিষানের সবুজ মাথাল।/ ঘাসফুলে ফড়িংয়ের লাফ দেখে/ রঙধনু ভেঙে নিয়ে নেচেছিল নরম কিশোরী।/ সেই গাঁয়ের পথে হেঁটে যেতে রাজহংস কাঁদে আজ/ ইতিহাসের চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়ে নোনা জল।/ সময়ের আয়ু গেছে ঘড়ির পেন্ডুলামে ক্ষয়ে-/ বিলম্ব করো না/ জল ও-জল হাসো, ভাসো/ স্বপ্ন দেখো এবং জাগাও মানুষ/ পুনর্বার হোক আনন্দ-শোভাযাত্রা/ সম্ভাবনার শিউলি ফুটুক প্রতিটি উঠোনে!’ (সম্ভাবনার শিউলি ফুটুক)।
‘আবুল হাসান নামে এক কবি ছিলেন/ এক পাথরের নাম ছিল আবুল হাসান।/ তুমি কি হীরা? তুমি পান্না কি কাঞ্চন/ এই পাথরের কাছে ¤্রয়িমাণ তুমি অকিঞ্চিতর!/ বিপুল এ পাথরের পাদদেশে বসে আছে-/ অজ¯্র ধ্যানী কলম ও কালি হাতে বহুকাল ধ’রে।/ আবুল হাসানের মহাপ্লাবনে জারিত স্বপ্নে/ ভেসে যাচ্ছে ঐরাবতের বিশাল দেহ,/ ভেসে যাচ্ছে আনন্দের ঈষৎ বেগুনি কচুরিফুল!/ আহ! ধরইনা পাখির পালকের মতো কিছু শুভ্র নম্রতা-/ মগজে রাখে কিছু বরফের শীতল স্ফটিক।/ ধীরে ধীরে চুয়ে পড়–ক লাবণ্য/ চুয়ে পড়–ক তারুণ্য/ চুয়ে পড়–ক আবুল হাসান।’ ( আবুল হাসান নামে)।
‘আমার পাখি জীবন ও ঘুমগাছ’ গ্রন্থটির প্রচ্ছদ মনোমুগ্ধকর। মেকিং যত্নশীল। এ কথা না বললেই নয় যে, কবিতাগুলোয় কিছু অনাহূত শব্দ এবং অনেকগুলো বানান ভুল চোখে পড়ার মতো। বানানে বিভ্রাটও রয়েছে কিছু; যেমন এক জায়গায় (মাংস) আরেক জায়গায় (মাংশ)। এখানে প্রকাশকও দায় এড়াতে পারেন না মোটেই। অভিযান প্রকাশনীর আরও (অন্তত) দশটি প্রকাশনে একই দুর্বলতা দেখেছি আগে। এক মগ দুধে এক ফোঁটা কালি যেমন গুণ নষ্টে বেশ কার্যকর, তেমনি একটি ভালো প্রকাশনে অল্পকিছু ত্রæটিই অনেক কিছু নয় কি? ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টে দেখলে- বক্তব্য, চিত্র, ভাব, বর্ণনা, কাব্যময়তা গুণের কারণে গ্রন্থটি বহুপাঠক গ্রহণ করবে বলে আশা। ত্রæটিগুলো পাছে ফেলে কবিতাগুলো ভালো লাগার প্রেক্ষিতে আমি কবি হাসান কল্লোল এবং ‘আমার পাখি জীবন ও ঘুমগাছ’ গ্রন্থটির সাফল্য কামনা করছি।
লেখক: জোবায়ের মিলন