দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা দমনে আরও কঠিন আইন প্রণয়ন করা হলো। সম্প্রতি ২০০০ সালের সংশোধিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের কিছু ধারা সংশোধন করা হয়েছে। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে সংশোধিত আইনে। এরই মধ্যে সংশোধিত আইনের গেজেটও প্রকাশ করা হয়েছে।
গণমাধ্যমসহ সর্বমহলে সরকারের এই সিদ্ধান্ত সাধুবাদ কুড়িয়েছে। তারপরও কি বলা যাবে যে নারী ধর্ষণ-নির্যাতন-সহিংসতা বন্ধ হয়ে যাবে?
তা বলা যাবে না। যদি তাই হতো, তাহলে এই আইন প্রণীত হবার পর গত ২৬ নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবসেই সংবাদপত্রের শিরোনাম দেখতে হতো না
‘মৃত্যুদন্ডের ভয় নেই ধর্ষকের’!
এই বাস্তবতা থেকেই উপলব্ধি করা যায় যে আইনই শেষ কথা নয়। নারীর প্রতি সহিংসতা তথা নির্যাতন-ধর্ষণ রুখতে হলে প্রয়োজন আমাদের মানসিক পরিবর্তন এবং সামাজিক প্রতিরোধ। পাশাপাশি চাই আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং কার্যকর করতে সংশ্লিষ্টদের নিষ্ঠা আর সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের নিশ্চয়তা।
নারী নির্যাতন নতুন কোনো বিষয় নয়। এটি চলে আসছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। মানুষ ধীরে ধীরে সভ্য হয়েছে, সমাজ-সংস্কৃতিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে, শিক্ষা-জ্ঞান-বিজ্ঞানে মানুষের অগ্রগতি হয়েছে, নারীসমাজও ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়াবার সুযোগ পেয়েছে। নির্যাতনের তথ্য ধীরে ধীরে সাংসারিক জীবনের চার দেয়ালের বাইরে এসেছে, আইন নির্যাতককে দমনে সক্রিয় হয়েছে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠেছে। সংবাদমাধ্যম সক্রিয় ভ‚মিকা রেখে চলেছে।
কিন্তু একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসেও আমরা বাংলাদেশের মানুষ কী জবাব দেব যদি প্রশ্ন করা হয়, কত দূর এগোল সভ্যতা?
বিশেষ করে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে আমাদের কতটা মনোভাবের পরিবর্তন বা চিন্তার অগ্রগতি হয়েছে?
নিশ্চিত করে বলতে পারি কাক্সিক্ষত মাত্রায় পরিবর্তন এখনো আসেনি। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-সংস্কৃতি, প্রযুক্তি-অর্থনীতিসহ অনেক ক্ষেত্রে আমরা এগিয়েছি, এ কথা ঠিক আমাদের জীবনমান বেড়েছে, আমাদের দারিদ্র্যের হার অনেক কমেছে, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে, দেশ হিসেবে আমরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গৌরবময় একটা অবস্থানে পৌঁছেছি।
বিশেষ করে গত এক দশকে যে অগ্রগতি হয়েছে বাংলাদেশের, তা ছিল অভাবনীয় এবং বিশ্বের উন্নয়নকামী দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল।
কিন্তু দুঃখের বিষয় এত অর্জনের পরও একটি ক্ষেত্রে আমাদের সমাজ-চরিত্র এখনো বদলায়নি, তা হচ্ছে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। এটিকে এক ধরনের মনোবিকলনও বলা যায়, আরও সহজ করে বললে পুরুষতান্ত্রিকতার বিকারগ্রস্ত আস্ফালন।
এই আস্ফালনেরই শিকার নারীসমাজ। অনেকে বলবেন, বাংলাদেশে নারী শিক্ষার হার বেড়েছে, নারীর ব্যাপক ক্ষমতায়ন হয়েছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেত্রী, স্পিকার নারী। সংসদ সদস্য, বিচারপতি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সচিব, সশস্ত্র বাহিনীসহ সকল ক্ষেত্রে অনেক নারী মর্যাদার আসনে।
তারপরও আমরা সেই পুরনো নৃশংস মানসিকতার বৃত্তে রয়ে গেলাম কেমন করে!
এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে আমাদের যেতে হবে সমাজ বাস্তবতার শিকড়ের কাছে। পরিবার থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রসহ সমগ্র সমাজে বিষাক্ত কাটার মতোই রয়ে গেছে পুরুষতান্ত্রিকতা, নারীকে হেয় করে দেখবার হীন মানসিকতা। পরিবারের কন্যা সন্তানটি সব সময় পুত্র সন্তানের চেয়ে অগ্রাধিকার এবং গুরুত্ব পেয়ে আসছে। এটা ধনী-গরিব, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল ক্ষেত্রেই সত্য।
নিবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করেছিলাম এই নারী নির্যাতন বহুকাল ধরে চলে আসছে এই বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা মানসিকতার কারণেই।
আরণ্যক জীবন ছেড়ে মানুষ আধুনিক জীবনে প্রবেশ করেছে বহুকাল আগে। নগরজীবন গড়ে তুলেছে, উন্নত সভ্যতা নির্মাণ করেছে, কিন্তু মনোবিকলন কম-বেশি রয়েই গেছে।
যে কারণে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা অঙ্গে দেখতে পাই নারীর প্রতি সহিংসতা আর নারীমুক্তির তীব্র আকাক্সক্ষার প্রকাশ। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে দেখি নারীকে মর্যাদাবান করবার জন্য কত মহান বাণী! ইসলামের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে সেই আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে যখন হযরত মুহাম্মদ (দ.) আখেরি নবী হিসেবে ইসলাম তথা শান্তির বাণী প্রচার করছেন, তখন নারীর প্রতি চরম সহিংসতা বন্ধের জন্য আখেরি নবী জানালেন :
মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে এবং মহাপুরুষদের বাণীতেও নারীর প্রতি সহমর্মিতা ও সম্মানবোধ প্রকাশ পেয়েছে একই কারণে। সনাতন ধর্মে দেবী দুর্গা তো অশুভ শক্তি নিধনের জন্যই এই পৃথিবীতে এসেছিলেন বলে মিথ রয়েছে। যেহেতু নারী নির্যাতন সভ্যতার আদি যুগ থেকে চলে আসছিল, শতবর্ষ আগেও আমরা দেখি রবীন্দ্রনাথের নাটকে, উপন্যাসে, কবিতায়, ছোটগল্পে নারী মুক্তির আকাক্সক্ষার নানা মাত্রিক প্রকাশ। নারীকে দিয়ে বিশ্বকবি বিদ্রোহও করিয়েছেন সামন্ততন্ত্র আর পুরুষের আধিপত্যের বিরুদ্ধে। যোগাযোগ উপন্যাসের কুমুদিনী সেই দ্রোহের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদায় অর্জুনকে শেষ পর্যন্ত চিত্রাঙ্গদা বলতে বাধ্য হন :
‘আমি চিত্রাঙ্গদা, আমি রাজেন্দ্রনন্দিনী।
নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী।
পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে সে নহি নহি।
যদি পাশে রাখো মোরে সংকটে সম্পদে,
সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে সহায় হতে পাবে তুমি চিনিতে মোরে। ’
নারীকে তার আপন শক্তিতে, আপন অস্তিত্বের মহিমায় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন কবি-সাহিত্যিকরা। চেয়েছেন উপেক্ষা থেকে তাকে তার আপন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে।
যে কারণে আমরা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলছেন:
‘বিশ্বের যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর …
এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল ফলিয়াছে
যত ফল
নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল।
কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়টি কত বোন দিল সেবা
বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কে বা।
পুরুষ হৃদয়হীন
মানুষ করিতে নারী দিল তারে আধেক
হৃদয় ঋণ।’
কিন্তু শতাব্দীকাল পরেও সেই ঋণ শোধ করার উপলব্ধি জাগেনি সমাজে। ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে নারীকে ভোগের বস্তু করে রাখবার অপপ্রয়াস সেকালে যেমন ছিল, একালে আরও প্রকটভাবে দৃশ্যমান। নারীকে মানুষ হিসেবে দেখবার বা পুরুষের সমকক্ষ করে দেখবার আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি অনেক উচ্চশিক্ষিত মানুষের মধ্যেও দেখা যায় না। সামাজিক, নৃতাত্তি¡ক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এত পরিবর্তন সত্তে¡ও হত্যা, ধর্ষণ নির্যাতন এবং সকল ক্ষেত্রে নারীকে অবহেলা এবং ছোট করে দেখবার অপসংস্কৃতি এখনো বিরাজমান।
আর তাই আইন করেই এই অপসংস্কৃতি থেকে আমরা মুক্তি পাব না, আরো অনেক কিছু করণীয় রয়েছে।
নারী-পুরুষের বৈষম্য তথা জেন্ডার বৈষম্য পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সকল ক্ষেত্রে বিরাজমান। আমাদের যুব তরুণেরা মানসিকভাবে দিন দিন নৃশংস হয়ে উঠছে। এই সহিংস মানসিকতা কেন গড়ে উঠছে, তার মূলে যেতে হবে। নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ-মমতা-ভালোবাসা পরিবার থেকেই সৃষ্টি হতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহপাঠীদের মধ্যে সৌজন্য এবং ভদ্রতার যে মূল্যবোধ, তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
পরিবার থেকেই যেহেতু সমাজ আর সমাজের বিস্তৃত রূপ নিয়েই রাষ্ট্র, সুতরাং রাষ্ট্রের একার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়। যদি না পরিবার থেকেই গড়ে ওঠে নারী-পুরুষের সমতার দৃষ্টিভঙ্গি। শিশুবেলা থেকেই বাবা-মা যদি ছেলে সন্তান এবং মেয়ে সন্তানের প্রতি সমান আচরণ করেন এবং তার পুত্রটি আধিপত্যের মানসিকতা নিয়ে গড়ে না ওঠে, সেই শিক্ষাটা যদি শৈশবেই দিয়ে দিতে পারেন, তাহলে তার সন্তানের পক্ষে কোনো নারীকে অপমান করা কিংবা কুদৃষ্টিতে দেখা সম্ভব নয়।
মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছরের দ্বারপ্রান্তে আমরা। জাতির পিতার জন্ম শতবর্ষ চলছে। যদি পেছনে ফিরে তাকাই, তাহলে দেখব এই দেশে প্রকৃত নগরায়ণ মাত্র বিশ-পঁচিশ বছরের। ছোট পরিবার নিয়ে নগর বাড়ছে! ভেঙে পড়েছে যৌথ পরিবারগুলো। ফলে শিশুরা দাদা-দাদী বা নানা-নানীর সাহচর্য্যে যে জীবনযাপন করত, সেখানে ছিল মায়ামমতা এবং স্বজনদের প্রতি ভালোবাসার শিক্ষা, তা একালের শিশুরা পাচ্ছে না। হলফ করে বলতে পারি এমন একদিন আসবে যখন যৌথ পরিবারে আমরা ফিরে যাবই, যেতে হবে। না গিয়ে উপায় থাকবে না। কোরআন এই দিকটিও আমাদের নাগরিক মানুষদের ভাবতে হবে। যেন শিশুরা দয়ামায়া স্নেহ-মমতার মানবিক মূল্যবোধের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়। তাহলেই প্রকৃত মানবিক চেতনায় বেড়ে উঠবে শিশুটি।
আমরা চাই বা না চাই আগামী ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের গ্রামগুলো শহরে রূপান্তরিত হবে। যৌথ পরিবার হয়তো আরও ভাঙবে। এই ভাঙনের হাত থেকে পরিবারগুলোকে রক্ষা করতে হবে। আমাদের শৈশবে গ্রাম সমাজ ছিল, প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশী নিবিড় সখ্য ছিল, ঝগড়াঝাঁটি ছিল আবার সামাজিক পারিবারিক যোগাযোগও ছিল। নিষ্ঠুরতা থেকে ভাবিপ্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে আমাদের অবশ্যই সামাজিক যোগাযোগবিচ্ছিন্ন করা ঠিক হবে না।
গণমাধ্যমের ভ‚মিকাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই। সংবাদপত্র টেলিভিশন এর পাশাপাশি নিও মিডিয়ার ভ‚মিকাও ইদানীং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সে বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণও করতে হবে। বিজ্ঞাপনের কথাই ধরুন। তিন দশক আগে দেখেছি শেভিং রেজারের বিজ্ঞাপনে একজন সুদর্শন পুরুষের ছবি থাকতো। অথচ মাত্র দুই দশকের ব্যবধানে দেখলাম সেই পুরুষের স্থানটি দখল করেছে সুন্দরী নারীর মুখ। নারীর অর্ধনগ্ন ছবি ব্যবহার করা হয়েছে।
এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে নারীকে নিজের মা-বোন-স্ত্রী স্বজন-পরিজনের দৃষ্টিতে দেখবার সামাজিক চোখ তৈরি করতে হবে, তা না হলে নারী নির্যাতন বা নারীর প্রতি হেয়দৃষ্টি থেকে সমাজ মুক্তি পাবে না।
তরুণ প্রজন্মের হাতে হাতে মোবাইল। অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলের ব্যবহার ব্যাপক হারে বেড়েছে। কিন্তু কী কাজে ব্যবহার করছে তারা অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল অভিভাবকরা তার খোঁজ রাখেন কজন। খোঁজ রাখতে হবে, তা না হলে অপরাধ জগত থেকে তাদের ফেরানো যাবে না, নেশার জগত থেকে ফেরানো যাবে না।
সোশ্যাল মিডিয়ার ইতিবাচক প্রভাব অনেক। কিন্তু ভয়ঙ্কর নেতিবাচক প্রভাবও কম নয়। সোশ্যাল মিডিয়া থাকবে কিন্তু তার অপব্যবহারের দিকটা দেখতে হবে রাষ্ট্রকে। চীনসহ বিশ্বের অনেক দেশে সোশ্যাল মিডিয়াও নিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহারের বিধান রয়েছে। টিকটক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে কোনো কোনো রাষ্ট্রে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ফেসবুক বা নিউ মিডিয়ায় কনটেন্ট তৈরি করে এর ব্যবহারকারীরা, এখানে আমাদের হাত নেই। তাই উপায় উদ্ভাবন করতে হবে কীভাবে নিও মিডিয়ার নেতিবাচক কনটেন্ট তথা অপব্যবহার বন্ধ করা যায়।
একসময় চলচ্চিত্রের ব্যাপক প্রভাব ছিল সমাজে। যে কারণে চলচ্চিত্রকে বলা হয় সমাজের দর্পণ। কিন্তু গত দুই দশকে সেই চিত্র পাল্টে গেছে। এখন বিজ্ঞাপন হচ্ছে বিপুল প্রভাব সৃষ্টিকারী মিডিয়া উপকরণ। একটি বিজ্ঞাপন হাজারবারও দেখানো হয়। প্রবীণ-নবীন সবার মনেই বিজ্ঞাপন গভীর প্রভাব বিস্তার করে। এর প্রতিক্রিয়া হয় তাৎক্ষণিকভাবেই।
যারা বিজ্ঞাপন নির্মাতা তাদেরকেও ভাবতে হবে নারীর মর্যাদা এবং সম্মানের বিষয়টি। এমন অশ্লীলভাবে যেন নারীকে আমরা পণ্য করে না তুলি বিজ্ঞাপনে, যাতে শ্রদ্ধার পরিবর্তে উগ্র লিপ্সার সৃষ্টি হয় পুরুষের মনে।
অশ্লীল ভিডিও যাতে নিউ মিডিয়ায় সহজে আপলোড-ডাউনলোড করা না যায়, সেদিকে কঠোর নজরদারি থাকতে হবে। যারা চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন, গণমাধ্যম বা সংবাদমাধ্যমের বিনোদন বিভাগগুলো পরিচালনা করেন, তাদেরও দৃষ্টিভঙ্গির আরো পরিবর্তন প্রয়োজন, যাতে অশ্লীল-ভালগার বিষয়গুলো আমরা সচেতনভাবে গণমাধ্যমে প্রচার পরিহার করতে পারি।
যদি সবাই সচেতন থাকি, নিশ্চিত করে বলতে পারি নারীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আরো অনেক ইতিবাচক হয়ে উঠবে, যার প্রভাব পড়বে আমাদের তরুণ প্রজন্মের মনেও।
জেন্ডার বৈষম্যের প্রসঙ্গ এই নিবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং সামাজিক সকল ক্ষেত্রেই আমূল পরিবর্তনের পথে যেতে হবে। কীভাবে সেই পরিবর্তন আসবে,তা গবেষক-বিশেষজ্ঞরা উদ্ভাবন করবেন।
ভিকটিমের চেয়ে পুরুষের যে নৃশংসতা, সেই দিকটির ওপর তথা নির্যাতক ব্যক্তিটির ওপর ফোকাস দিতে হবে গণমাধ্যমে। নারীকে সুরক্ষা দিয়েই করতে হবে অপরাধের তদন্ত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সকলকেই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে হবে ভিকটিমকে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, অনেক ক্ষেত্রেই সেই দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত অবস্থানে আমরা দেখতে পাই কোনো কোনো আইনশৃঙ্খলার রক্ষককে।
সামাজিক বিচ্ছিন্নতার কারণেই আমরা সমাজে অনেক নৃশংস দৃশ্য দেখেও সহমর্মী হই না আজকাল। কুপিয়ে হত্যা করা হচ্ছে কাউকে, তাকে আগে বাঁচানোর পরিবর্তে ভিডিও করতে ব্যস্ত হয়ে যাই এবং সেই ভিডিও ভাইরাল করার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠি!
এই ভয়ঙ্কর মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে মানবিক মমতা ও সহমর্মিতার সমাজ ও মানস গঠনের কোনো বিকল্প নেই। আত্মকেন্দ্রিকতা এবং স্বার্থপরতার মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে। সকলে আমরা সকলের তরেÑএই চিরসত্য মানবিক মূল্যবোধ সমাজে ফিরিয়ে আনতেই হবে।
স্কুল পর্যায় থেকেই যৌনশিক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে শিশু-কিশোররা তার স্বজন-পরিজন নির্বিশেষে সকল নারীকে উদার দৃষ্টিতে দেখবার মানসিক ইতিবাচক বোধ নিয়ে বেড়ে ওঠে।
নারী ধর্ষণ কিংবা নির্যাতনের এত ব্যাপক বিস্তারের মূলে আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য, এই বাস্তবতা বিদ্যমান না থাকাও অন্যতম কারণ। প্রভাবশালী হলে তারা আইনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে আসে, সেই প্রভাবের ভয়ে ধর্ষণ কিংবা নির্যাতনের সাক্ষ্য দিতে এগিয়ে আসে না অনেকেই। প্রভাবশালী কেউ অপরাধী হলে তো আর কথাই নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত যারা, তারাও এক্ষেত্রে দুর্বলতার পরিচয় দিয়ে থাকেন অনেক ক্ষেত্রে।
এ অবস্থার অবসান হতে হবে। নারী নির্যাতন কিংবা ধর্ষণ রুখতে হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দ্রæততম সময়ে নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে যে সকল বাধা এখনো বিদ্যমান, তা দ্রæত নিরসন হওয়া দরকার।
সরকার নারী নির্যাতন-ধর্ষণ রোধে কঠোর আইন করে দিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে হলে নাগরিকসমাজ তথা সমাজের সকল ক্ষেত্র থেকেই সহযোগিতার প্রয়োজন। তাহলেই সত্যিকারের একটি উন্নত মানবিক মর্যাদাপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব।
তা না হলে আমরা যতই অর্থনৈতিকভাবে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হই না কেন, মর্যাদাবান জাতি হিসেবে অগ্রসর হতে পারব না। ষ
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কবি