
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলছে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ক্যাম্পেইন। এক জরিপে দেখা গেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা মহামারীর মধ্যে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে। পারিবারিক নির্যাতন ও সহিংসতা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে এমন কয়েকটি ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, যার নারকীয়তায় স্তম্ভিত হয়েছে মানুষ এবং প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। কিন্তু তারপরও বন্ধ হয়নি ধর্ষণের অপরাধ। করোনার প্যানডেমিক যখন চলছে সেই সময়েও ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ বন্ধ হচ্ছে না, বরং বাড়ছে। সেই সময়ও নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, হচ্ছে হত্যার শিকার। সম্প্রতি নারীদের ভিকটিম হওয়ার পাশাপাশি আরেকটি ভয়াবহ প্রবণতা হলো ছেলে শিশুদের ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনা। যা অতি ভয়ঙ্কর ও দুঃখজনক। লকডাউনের ভিতরেও কিন্তু দেশে ধর্ষণের ঘটনা থেমে ছিল না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, আইন ও সালিশ কেন্দ্র তাদের নিয়মিত প্রতিবেদনে জানাচ্ছে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত গত ছয় মাসে ৬০১ নারী ও শিশু বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। একক ধর্ষণের শিকার ৪৬২ জন এবং দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ১৩৪ জন। রেপ ভিকটিমদের মধ্যে ৪০ জনের বয়স ছয় বছরের মধ্যে এবং ১০৩ জনের বয়স ১২ বছরের মধ্যে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৭জনকে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন সাতজন। ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে ১২৬ জনের ওপর।
ধর্ষণের শাস্তি সর্বোচ্চ ক্ষেত্রে মৃত্যুদন্ড ঘোষিত হয়েছে বিশেষ অধ্যাদেশের ফলে। সা¤প্রতিক ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতেই এটি করা হয়েছে। কিন্তু ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড প্রবর্তন দেশব্যাপী ধর্ষণের মহামারী প্রতিরোধে কতটা কার্যকর হবে সেটা গুরুতর প্রশ্ন। বুঝলাম শাস্তি মৃত্যুদন্ড। কিন্তু ধর্ষককে তো বিচারের কাঠগড়া অবধি নিতে হবে। অপরাধ এবং অপরাধীর শাস্তি কার্যকর এই দুইয়ের মধ্যে যে রয়ে গেছে যোজন যোজন ফারাক।
ধর্ষণসহ নারী ও শিশুর (ছেলে ও মেয়ে উভয় প্রকার শিশু) প্রতি সংঘটিত সকল প্রকার সহিংসতাই মূলত ক্ষমতার প্রতাপ, দুর্বলের ওপর সবলের নির্যাতন, নারী ও শিশুর ওপর ক্ষমতা দেখানো, নারীকে শায়েস্তা করার মানসিকতা, বিচারহীনতা, সামাজিক বৈরিতা ইত্যাদি নানা রকম কারণের ফল। সমাজে যদি বৈষম্য খুব বেশি থাকে তাহলে সহিংসতা রোধ করা সম্ভব নয়। আমাদের সমাজে দরিদ্র নারীর অবস্থান সবচেয়ে প্রান্তিক। কারণ দরিদ্রতার কারণে এবং নারী হওয়ার কারণে সে ক্ষমতা কাঠামোর সবচেয়ে তলানিতে অবস্থান করে। এদেশে অধিকাংশ ধর্ষণের শিকার হয় দরিদ্র শ্রেণীর নারী ও শিশু। ভিকটিম হওয়ার পরও সে বিচারের দরজা পর্যন্ত যেতে পারে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষণকারী সামাজিকভাবে ক্ষমতাবান এবং কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভিকটিমের কেস নিতে গড়িমসি করে, মেডিকেল পরীক্ষার সময় ভিকটিম আরেক দফা ট্রমার মধ্যে পড়ে, সময়মতো মেডিকেল রিপোর্ট পাওয়া যায় না, আইনগত সহায়তা পাওয়ার মতো আর্থিক অবস্থাও থাকে না অনেক ভিকটিমের। এর উপর থাকে ধর্ষকদের হুমকি। যদিই বা ধর্ষক গ্রেপ্তার হয় তো তারপরও জামিনে বেরিয়ে এসে (যদিও ধর্ষণ অজামিনযোগ্য অপরাধ) ভিকটিমকে হয় মেরেই ফেলে অথবা এলাকা ছাড়া করে। ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদন্ড মানেই যে দেশ থেকে রাতারাতি ধর্ষণ বন্ধ হয়ে যাবে সে আশায় নিশ্চিত গুড়েবালি।
ধর্ষককে দ্রুত গ্রেপ্তার, ভিকটিমের মেডিক্যাল পরীক্ষায় হেনস্তা বন্ধ, ভিকটিম ও তার পরিবারকে নিরাপত্তা দান, ভিকটিমকে চিকিৎসা প্রদান, ধর্ষণের দ্রুত বিচার, শাস্তি কার্যকর, ধর্ষকের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাপট থেকে ভিকটিম ও তার পরিবারকে রক্ষা এগুলো কে করবে?
ধর্ষণসহ সকল প্রকার নারী নির্যাতনের যে ভাইরাস বাংলাদেশে বিস্তার লাভ করেছে তার পিছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের বিচারহীনতা। যখন অপরাধ করে অপরাধী পার পেয়ে গেছে তখন নতুন অপরাধীদের জন্ম হয়েছে। তারা দেখেছে যে এই অপরাধ করে যেহেতু কোনো বিচার হচ্ছে না তাহলে অপরাধ করতে বাধা কোথায়? নারীর প্রতি অশালীন, বীভৎস মন্তব্য করতে করতে, নারীকে কেবল মাত্র যৌনবস্তু বলে প্রচার করতে করতে আর বিচারহীনতা ও ক্ষমতার প্রশ্রয়ে পার পেয়ে যেতে যেতে এই অবস্থা।
নারী নির্যাতনের ভাইরাস বাংলাদেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এখানে এখন ধর্ষণের মহামারী চলছে। শুধু যে নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তা নয়। মাদ্রাসার ভিতরে, এতিমখানায় অনেক ছেলে শিশুও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ধর্মীয় মৌলবাদ দেশটিকে এত আষ্টে পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে যে, এখন মৌলবাদী গোষ্ঠি ও তাদের অনুচররা প্রেসক্রিপশন ঝাড়ছে যে, পর্দা করলে ধর্ষণ বন্ধ হবে। পোশাকের কারণে ধর্ষণ হয় এটা হলো সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মিথ্যা কথা যা মৌলবাদ ও পুরুষতন্ত্র প্রচার করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।
মসজিদের ভিতরে, মাদ্রাসায় যে অসংখ্য শিশু ও কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়, তারা সারা দেহ বস্ত্রাকৃত করেও ধর্ষণের শিকার হওয়া থেকে বাঁচতে পারেনি। বাঁচতে পারেনি তনু, নুসরাতের মতো অসংখ্য মেয়ে।
বাংলাদেশে নারীর পোশাকে অশালীনতা কোথায়? বাংলাদেশের সাধারণ নারীরা পরেন সালোয়ার কামিজ অথবা শাড়ি। এই পোশাক কি অশালীন? পাশ্চাত্যের পোশাকও অশালীন নয় যদিও তা এদেশের নারীরা পরেন না। বাংলাদেশের নারীরা কি বিকিনি পরে রাস্তায় হাঁটেন? পোশাকের কথাটি কেন তোলে এই ভন্ডের দল? মাদ্রাসার ভেতরে ছেলে শিশুদের যে ধর্ষণ করা হয় সেটা কোন পোশাক পরালে, কিভাবে পর্দা করলে বন্ধ করা যাবে জানতে চাই। আবারও বলছি, ধর্ষণের জন্য পোশাক দায়ী নয়। দায়ী হলো ক্ষমতার প্রদর্শন, বিচারহীনতা, বিকৃত মানসিকতা ও নারীর ওপর নিয়ন্ত্রণকামিতা, নারীকে নিজের বশে এনে তাকে শায়েস্তা করার প্রবণতা।
ধর্ষণের ক্ষেত্রে আরেকটি বহুল প্রচলিত ভন্ডামি হলো, ভিকটিমের চরিত্র খারাপ এটি প্রচার করার চেষ্টা করা। এটিও একটি চরম অবান্তর কথা। কারণ ভিকটিমের চরিত্র তো কোথাও আলোচ্য নয়। আমাদের দেশের কোন আইনে কি ভিকটিমের চরিত্র খারাপ হলে তাকে ধর্ষণ করার বিধান রয়েছে? ভিকটিমের চরিত্রে অপবাদ দিয়ে তো ধর্ষণের অপরাধকে লঘু করা যায় না। একজন যৌনকর্মীকে ধর্ষণ করারও অধিকার কাউকে দেয়া হয়নি। যৌনকর্মীকে ধর্ষণ করলেও সেটা ধর্ষণই থাকে, বৈধ হয়ে যায় না। সেটাও গুরুতর অপরাধ এবং সেখানেও শাস্তি কার্যকর হওয়া উচিত বিনা বাধায়।
আসল কথা হলো, ধর্ষণ একটি নির্যাতনমূলক, মানবতাবিরোধী কর্মকান্ড। এটাকে তোষণ করে ক্ষমতা ও প্রভাব, রাজনীতি এবং দুর্বলের ওপর সবলের নিয়ন্ত্রণকামিতা।
ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন একটি লাগাতার প্রক্রিয়া। একে ধরে রাখতে হবে। সমাজের সর্বস্তরে নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে ধর্ষণ ও সকল প্রকার সহিংসতা রোধ সম্ভব নয়। সেইসঙ্গে নির্যাতকদের ক্ষমতার আশ্রয় প্রশ্রয় দান বন্ধ করতে হবে। সমাজ থেকে বৈষম্য দূর এবং নারী-পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠাই নারী নির্যাতন নামক ভাইরাসের কার্যকরী ভ্যাকসিন। দলমতধর্ম নির্বিশেষে ধর্ষণকে প্রতিরোধ করুন। নারী ও উভয় প্রকার(ছেলে ও মেয়ে) শিশুর উপর সংঘটিত সকল ধর্ষণের বিচার চাই।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে চলমান ক্যাম্পেইনের সময় আরেকটি দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
পার্বত্য জেলাগুলোতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ওপর বাঙালি সেটেলারদের নিপীড়ন নির্যাতনের অভিযোগ আজকে নতুন নয়। বছরের পর বছর ধরে এদের ধর্ষণ ও নির্যাতন চলছে পাহাড়ি মানুষের ওপর। যাদের ভ‚মি, তাদেরই সেই ভ‚মি থেকে উচ্ছেদ করে এরা নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী কখনও প্রতিকার পায়নি। পাহাড়ি নারী ধর্ষণের কোনো সুষ্ঠু বিচারও হয়নি। কোনো ধর্ষকেরই কঠোর শাস্তি হয়নি।
বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের কোনো মানসম্মান অবশিষ্ট থাকবে না যদি একের পর এক ধর্ষণের ও নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতার বীভৎস ঘটনা ঘটতে থাকে। এখন তো, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ধর্ষকের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। অমানুষরা বিকৃতির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। নারীর প্রতি ন্যূনতম সম্মান ও মর্যাদা এদেশের সিংহভাগ পুরুষের নেই। এ কথার প্রমাণস্বরূপ আমি যে কোন নিউজ পোর্টালের নারী অধিকার বা এ ধরনের লেখার নিচে প্রকাশিত মন্তব্যগুলো পড়তে আহ্বান জানাই। কুৎসিত ভাষায় সেখানে নারীর উদ্দেশ্যে গালাগাল বর্ষিত হয়। যারা এসব কুৎসিত মন্তব্য করে তারা নিঃসন্দেহে ধর্ষকামী। এরা পটেনশিয়াল ধর্ষক। সময় ও সুযোগ পেলে এরা যেকোনো নারীকে ধর্ষণ করবে। রাস্তাঘাটে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি যারা করে, যারা ভিড়ের বাসে সুযোগ পেলে নারীকে অশালীনভাবে ধাক্কা দেয়, যারা পথচলতি বা রিকশাযাত্রীর নারীর উদ্দেশ্যে নোংরা মন্তব্য ছুড়ে দেয় তারা সবাই পটেনশিয়াল ধর্ষক।
কিন্তু কেন এত ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে? কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না এই জঘন্য অপরাধ? এই অপরাধ বন্ধ করতে একদিকে দরকার আইনের কঠোর প্রয়োগ, অন্যদিকে দরকার উপযুক্ত শিক্ষা।
দু’চারজন ধর্ষককে ফাঁসিতে ঝোলানো দরকার সবার আগে। দৃষ্টান্তমূলক কয়েকটি শাস্তির ঘটনা ঘটলেই অন্য সম্ভাব্য অপরাধীরা ভয় পাবে। আবারও বলছি, দ্রুত বিচারের আওতায় ধর্ষণের বিচার হওয়া দরকার।
আর সবচেয়ে বেশি দরকার গণমাধ্যমে এবং সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা। শিশু ও নারীর বিরুদ্ধে সকল প্রকার সহিংসতারোধে সমাজে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। নারীকে যৌন সামগ্রী ভাবার অসুস্থ মানসিকতা দ‚র করতে হবে সমাজ থেকে।
ধর্ষণ ও নারীর প্রতি যৌন হয়রানিকে অনেক পুরুষই বড় কোনো অপরাধ বলে মনে করে না। ভাবখানা হলো, ইচ্ছা করলেই একটি মেয়েকে ধর্ষণ করা যায়। এতে আর এমন কি ক্ষতি হয়!
এদের কাছে ধর্ষণ একটি বিকৃত বিনোদন মাত্র। এটি যে গুরুতর অপরাধ এবং এর শাস্তি যে কঠোর সে কথাটি প্রচার করতে হবে সমাজের সর্ব স্তরে। মামলার দীর্ঘস‚ত্রিতা, ভিকটিমের মেডিকেল পরীক্ষায় হয়রানি, প্রভাবশালীদের হুমকি, ধর্ষককে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় এসব কারণে অপরাধীদের ধারণা হয় ধর্ষণ করে পার পাওয়া যাবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতিই এর জন্য দায়ী।
সরকারকে জিরো টলারেন্স মনোভাব নিয়ে প্রতিটি সহিংসতার ঘটনার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি সেবাম‚লক সংস্থাকে ধর্ষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।
এদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। অর্ধেক জনগোষ্ঠী যদি সদা সর্বদা ভিকটিম হওয়ার আতঙ্ক নিয়ে বেঁচে থাকে, তাহলে কিভাবে তারা উন্নয়নের অংশীদার হবে? একেবারে শৈশব থেকে পুরুষকে ধর্ষণবিরোধী করে গড়ে ওঠার শিক্ষা দিতে হবে। দেশকে নারী নির্যাতনমুক্ত করা এখন এক নম্বর জাতীয় কর্তব্য।