পাঠকক্ষ

পিনদ্ধ বুননের কাব্যগ্রন্থ ‘আঁখিআঁকা আদিনাথ’

নতুন শতাব্দীর কবি নিলয় রফিক। মূলত শৈশব ও প্রকৃতিনির্ভর নিলয় তার প্রতিটি কাব্যগ্রন্থে উপরে উল্লেখিত দুটি বিষয় সরবে উপস্থিত। এ পর্যন্ত কবি নিলয় রফিকের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে- বিশুদ্ধ বিষাদে ভাসি আমি রাজহাঁস (২০১৪), পিপাসার পরমায়ু (২০১৬), নোনা মানুষের মুখ (২০১৭), অজ্ঞাত আগুন (২০১৯) এবং চলতি বছর প্রকাশিত ‘আঁখিআঁকা আদিনাথ’।
কবি নিলয় রফিকের আঁখিআঁকা আদিনাথ কাব্যগ্রন্থটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত। তার আগের কাব্যগ্রন্থ কয়েকটি অক্ষরবৃত্তে লেখা। আলোচ্য কাব্যগ্রন্থ থেকে কয়েকটি কবিতার পঙ্ক্তিমালা কাব্যপাঠকের সমীপে উপস্থাপন করলাম-
১. ‘আদিশৈলী ইতিহাসে বোধের রহস্য/কাঠমিস্ত্রি কর্মচারু আমার ঐতিহ্য।’ (আমার ঐতিহ্য, পৃষ্ঠা ০৯)
এ কবিতায় কবি তার পূর্বপুরুষের পেশাকে অস্বীকার করতে পারেননি। এক্ষেত্রে কবি সততার পরিচয় দিয়েছেন। বাংলার চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানও তার পিতার কাঠমিস্ত্রি পেশাকে সগৌরবে স্বীকার করেছেন। এখানে কবি নিলয় রফিক এবং শিল্পী সুলতান একই সমতলে মেরুদÐ সোজা করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তার শরীরে শ্রমিকের রক্ত বহমান। তিনি গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে কবিতার স্বর শোনেন। সমুদ্রসন্তান কবি নিলয় রফিক। সমুদ্রের ভাষা তার মনের গভীরে প্রতিনিয়ত সুর তোলে। সমুদ্রের মাতাল জোয়ারে সবকিছু ভেসে যায়, এ করুণ দৃশ্যটি তার চোখ থেকে সরে যায়নি কখনো।
যেমন-
২. ‘নিসর্গশহরে ঘূর্ণি, বায়ুচাপে ঝড়ের আকাশ/আগুনে ফুলকি গ্রাসে, চিরঘুমে তরতাজা প্রাণ/ বিষাদে চোখের জলে, ফুলবাগে অমানিশা ঢেউ/ভেঙে পড়ে বৃক্ষসারি মাটিঘরে হারানো জিকির।’ (মৃত্যুর সমন, পৃষ্ঠা ১১)
৩. “মনে পড়ে মা’র হাসি, সুপ্রভাতে আলোর নন্দন/লুকিয়ে হাতের ফাঁকে, সুখটানে শিল্পের মগ্নতা/দরজা জানালা-ঘর, আলমারি রক্তের শেকড়/ভাষাশৈলী মিস্ত্রিবাড়ি গুপ্তধন কাঠের বোতাম।” (কাঠের বোতাম, পৃষ্ঠা ১২)
উল্লেখিত পঙ্ক্তিগুলোয় কবি নিলয় রফিক প্রকৃতির সঙ্গে গৃহস্থের জীবনযাপন কাব্যিক মহিমায় মিলিয়ে দিয়েছেন এবং তিনি সাহসের সঙ্গে উচ্চারণ করেছেনÑ
৪. “অঝোরে বর্ষার জল মিশে যাবে পৃথক কৌশল।” (কাঠের বোতাম, পৃষ্ঠা ১২)
কবি ‘পৃথক কৌশল’ শব্দবন্ধনটি ব্যবহার করে অতীত ও সমকালে এ সমাজে নেতিবাচক চর্চার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
এ গ্রন্থের কবি নিলয় রফিক ঘরের ভেতর দেখেন আলোর সৌন্দর্য আর শব্দের বাড়িতে শোনেন ঝড়ের সুমধুর কল্লোল ধ্বনি। কিন্তু ঝরাপাতার রুচিহীন নৃত্যে দেখেন সর্বদা বিষের ফণা। তিনি ‘আত্মলিপি’ কবিতায় বলেনÑ
৫. “সুন্দর ঘরের আলো, শব্দবাড়ি ঝড়ের কল্লোল/ ঝরাপাতা রুচিহীন নৃত্য দোলে বিষের ফণায়।” (আত্মলিপি, পৃষ্ঠা ১৩)
এবার কবি নিলয় রফিকের ‘আঁখিআঁকা আদিনাথ’ কাব্যগ্রন্থের বেশ ক’টি কবিতার মনে রাখার মতো পঙ্ক্তি তুলে দিলাম। পঙ্ক্তিগুলো কাব্যপ্রেমী সচেতন পাঠকের মনে দোলা দেবে বারবার।
“সমুদ্র-সান্নিধ্যে এসে, চিরায়ত রূপের নির্জন/তরঙ্গ শিকারি নদী, ধ্যানের মগ্নতা জলে ডুবে।” (তরঙ্গ শিকারি, পৃষ্ঠা ১৪)
“ফিরে যাবে ইতিহাসে, শাড়ির আঁচল/টান মেরে খুলে নেবে সতীত্ব লুণ্ঠন।” (সতীত্ব লুণ্ঠন, পৃষ্ঠা ১৫)
“এতো লজ্জা ইতিহাসে বিপুল বিরল/নক্ষত্রের জয়গান আলোর মুজিব।” (মৈনাক চ‚ড়ায়, পৃষ্ঠা ২৭)
“শিউলিতলায় রাতে প্রমত্ত আকাশ/ঘুমঘোরে রৌদ্র পুড়ে অনাবৃত দৃশ্য!” (আদিপথ, পৃষ্ঠা ৩৭)
“বাউল ফকিরবাড়ি বাউলের রাত/শাহ করিমের ঠোঁটে আলোর আকাশ।” ( রোদের সকাল, পৃষ্ঠা ৩৯)
“খুলে দেখি স্মৃতিলতা ঝরে পড়া ছায়া/বাতাসে সাম্পানে ভাসে হারানো মিছিল।” (বাতির ভেতর দেহ, পৃষ্ঠা ৪৩)
“জন্ম শেকড়ের বেড়ে ওঠা স্মৃতি, সবুজে অরণ্য/দরজা সামনে ছায়া, আয়ুবৃক্ষ মায়ের পলক” (আয়ুনাজল, পৃষ্ঠা ৫৫)
এ ধরনের অনেক পঙ্ক্তি কবি নিলয় রফিকের ‘আঁখিআঁকা আদিনাথ’ কাব্যগ্রন্থে বিরল নয়, সুলভ তো বটেই।

পিনদ্ধ বুননের এ কাব্যগ্রন্থের প্রায় কবিতা শৈশব ও জন্মগ্রামের প্রকৃতির ¯িœগ্ধ চিত্রকল্প বিদ্যমান। শৈশবের স্মৃতি এবং প্রকৃতির শোভাময় রূপ কবিকে মুগ্ধ করে রেখেছে প্রতিনিয়ত। নিলয় রফিক সমূলে শৈশব ও নিসর্গমনস্ক কবি। তার নজরে এ দুটি বিষয় অক্ষত ও অ¤øান। আজকের প্রেক্ষাপট কবি নিলয় রফিকের সমুদ্র¯œাত জন্মস্থানের কাঠামো ও দৃশ্যের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষের আচরণে দেখা যায় পরিবর্তনের ছোঁয়া। সময়ের এ পরিবর্তনকে কাব্যের মাধ্যমে স্বাগত জানাতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যুগে এ পরিবর্তন অনিবার্য ও স্বাভাবিক। এ সময়ের কবিকে এ ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। আশা করি আগামীতে কবি তার কবিতায় সমকালের বিষয়গুলো সুচারুভাবে কাব্যিক বয়ানে তুলে আনবেন। এটা আধুনিক তথা বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সময়কে ধারণ করে আজকের কবিতার অন্যতম নবজাগরিত বৈশিষ্ট্য। ‘আঁখিআঁকা আদিনাথ’ কাব্যগ্রন্থের ফ্ল্যাপ লিখেছে কবি আবু হাসান শাহরিয়ার। তৃতীয়চোখ থেকে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থটির প্রকাশক আলী প্রয়াস। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০২১, মূল্য ১৫০ টাকা।

লেখক: শাহিদ হাসান

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button