প্রাণঘাতী করোনাকালে মানবিক ভূমিকা রেখে পুলিশ বাহিনী প্রশংসা কুড়িয়েছে সকলের। এ সময়ে জীবন বাজি রেখে মানুষের পাশে থেকে সেবা দিয়েছে পুলিশ। দিয়ে যাচ্ছে এখনো। এতে অনেক পুলিশ সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন। তবু পুলিশ বাহিনী মানবিক সেবা থেকে পিছু হটেনি। পাশাপাশি মানুষের বন্ধু হয়ে পাশে থেকেছেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। এত কিছু ছাপিয়ে কক্সবাজারে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা পুলিশ বাহিনীকে ইমেজ সংকটে ফেলে দেয়। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ও দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসারদের কড়া বার্তা দিতে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু করে সরকার। এ অভিযানের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো দক্ষ ও যোগ্য অফিসারদের পদায়ন করে কাজে গতিশীলতা আনা। সূত্র এমনই বলছে।
অভিযানের শুরুতে কক্সবাজারে একযোগে তিন হাজার পুলিশকে বদলি ও নিয়োগদানের মতো সাহসী পদক্ষেপের ঘটনা পুলিশ প্রশাসন তথা সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। স্বাধীনতার পর বিগত ৪৯ বছরে দেশের একটি জেলায় একসঙ্গে এত বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য বদলি ও নিয়োগদানের ঘটনাটি এ বাহিনীতে নানা অপরাধে জড়িত পুলিশ সদস্যদের জন্য কঠোর বার্তা বলে মনে করা হচ্ছে।
জনবান্ধব ও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে পুলিশ বাহিনীতে এ শুদ্ধি অভিযান চলমান রেখেছে সরকার। সারা দেশে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, মাদকাসক্ত ও মাদক কারবারসহ নানা ধরনের অপরাধে জড়িত পুলিশ সদস্যদের তালিকা তৈরি করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পুলিশে কর্মরত মাদকাসক্তদের ডোপ টেস্ট হচ্ছে। টেস্টে পজিটিভ সদস্যদের চাকরিচ্যুত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে পুলিশ প্রশাসন। মানবিক পুলিশ হিসেবে বিদেশের মডেলে ঢেলে সাজানো হচ্ছে পুলিশ বাহিনী। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
দুর্নীতি বা অপরাধ দমনে পুলিশ বাহিনীতে শুদ্ধি অভিযানের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। মাঝে মধ্যে এ ধরনের অভিযান হলে দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যরা কিছুটা হলেও খামোশ হবে। ভয় পাবে। আর এজন্য বেশি গুরুত্ব দিতে হবে আইনের শাসনের ওপর। সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ওপর ভরসা করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি দুর্নীতির ফাঁকফোকরগুলো বন্ধ করা অতি জরুরি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান অভিযানে আইন সবার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রয়োগ করতে হবে। কাউকে ধরা ও কাউকে ছাড় দেয়ার নীতি পরিহার করতে হবে। এভাবেই রাষ্ট্রযন্ত্র দুর্নীতির বিপরীতে সুনীতি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি খবরে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) বিতর্কিত যেসব কর্মকর্তা দীর্ঘদিন ধরে একই থানায়, ফাঁড়ি বা দপ্তরে কর্মরত রয়েছেন, তাদের তালিকা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের সরিয়ে সৎ ও দক্ষ অফিসার পদায়ন শুরুও হয়েছে। জানা গেছে, গত ৭ সেপ্টেম্বর সিএমপির ৩০তম পুলিশ কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব নেন সালেহ মোহাম্মদ তানভীর। পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তিনি মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের অনিয়মের বিরুদ্ধে তার অবস্থান সম্পর্কে বার্তা দিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় বিতর্কিত ও অযোগ্যদের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে তালিকা বানানোর কাজ শুরু করেন। দক্ষ ও চৌকস কর্মকর্তাদের বিষয়েও খোঁজ নিচ্ছেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিএমপির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, টাকার বিনিময়ে ওসি পদায়নের ধারণা এখন শেষ। দক্ষ ও যোগ্যদের মূল্যায়ন করে পুলিশিংয়ে গতিশীলতা আনা হচ্ছে।
তবে শুদ্ধি অভিযান সম্পর্কে সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর বলেছেন, ‘শুদ্ধি অভিযান কথাটি আসলে ঠিক নয়, আমি যোগ্য লোকদের যোগ্য জায়গায় পদায়ন করছি। এর বেশি কিছু নয়। তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কাজের। ভালো কাজ করলে যেমন পুরস্কৃত হবেন, তেমনি খারাপ কাজ করলে তার দায়ভার তাকেই নিতে হবে, এটি (বদলি) একটি প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার অংশ। ’
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাতে কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে হত্যার পর পুলিশের ভাবমূর্তি তলানিতে গিয়ে ঠেকে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ দাশ, পরিদর্শক লিয়াকতসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তদন্ত চলছে। সেই শুরু। এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই একযোগে অনেক পুলিশের বদলি ও নিয়োগ দেয়ার ঘটনাটি পুলিশ বাহিনীতে একটি মাইলফলক হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশ অনুযায়ী সারা দেশে দুর্নীতিবাজ, অসৎ, ঘুষখোর, মাদকাসক্ত ও মাদক কারবারের সঙ্গে যুক্তসহ নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। পুলিশ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ৯৫ থেকে ৯৭ ভাগই সৎ, চৌকস ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। বিশেষ করে গত ১০ বছরে পুলিশে নিয়োগের ক্ষেত্রে একটা স্বচ্ছতা তৈরি হয়েছে। এটি দুর্নীতির উৎস বন্ধের অন্যতম একটি ধাপ।
এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে চলছে শুদ্ধি অভিযান। সন্দেহভাজন মাদকাসক্ত সদস্যদের ডোপ টেস্ট চলছে। জানা গেছে, কেননা বিষয়টি বাহিনীর জন্য বিব্রতকর বিধায় এ শুদ্ধি অভিযান চলমান থাকবে। শুধু তা-ই নয়, পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ছোট-বড় যেকোনো ধরনের অপরাধ প্রমাণ হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানা গেছে।
ডিএমপি কমিশনার বলেছেন, পুলিশের আচরণের ক্ষেত্রে বিরূপ সমস্যার কথা সবাই বলেন যে, পুলিশ কাজ করে, কাজ করার আগে দুটা ধমক দেয়। অথবা থানায় গেলে প্রথমেই একটা বিরূপ ধমকের সম্মুখীন হতে হয়। এ বিষয়গুলো থেকে বের হয়ে আসার জন্য আমরা অফিসারদের মোটিভেট করছি। যারা এ ধরনের আচরণ করছে, তাদের শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। মোদ্দাকথা, থানায় গিয়ে সেবাপ্রত্যাশী কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হয়, সে বিষয়টি নিবিড় মনিটরিং করা হচ্ছে। ট্রেনিং একাডেমিতেও এই আচরণগত সমস্যার বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে প্রশাসন।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশ গঠনে পুলিশ বাহিনীর ভ‚মিকা অতুলনীয়। পুলিশ বাহিনীর অনেক সুনাম, অনেক অর্জন ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গঠিত এ বাহিনী দেশের মানুষের জানমালের হেফাজত, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণসহ প্রাত্যহিক অনেক দায়িত্ব পালন করে চলেছে আন্তরিকতার সঙ্গে। পুলিশের মূলমন্ত্র যেটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন, তা হচ্ছে পুলিশ হবে জনগণের বন্ধু। তবু কিছু ক্ষেত্রে কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তার দুর্নীতি, অনিয়ম ও অপকর্মের কারণে এ বাহিনীর ভাবমূর্তি সংকটের মধ্যে পড়েছে। কিছু ঘটনা পুলিশের অর্জন, সততা ও নিষ্ঠা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এসব কারণে পুলিশের নবনিযুক্ত আইজি বেনজীর আহমেদ পুলিশে শুদ্ধি অভিযানের উদ্যোগ নিয়েছেন। এটিকে দেশবাসীর আস্থা, বিশ্বাস, নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা নিয়ে কাজ করে দেশজুড়ে পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার একটি প্রয়াস হিসেবে ধরা হচ্ছে। পুলিশের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছেন, বর্তমান আইজি বেনজীর আহমেদ বাহিনীর দুর্নীতি চিরতরে অবসানের জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন। আইজি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি বলেছিলেন, তিনি কলঙ্কমুক্ত পুলিশ বাহিনী করতে চান ও পুলিশকে জনগণের বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে চান।
সর্বোপরি এ শুদ্ধি অভিযান শুরু করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন। শুদ্ধি অভিযান থামানো যাবে না। দেশের মানুষ শুদ্ধি অভিযানের সফলতা দেখতে চায়, ব্যর্থতা নয়।