
আজ ১৫ ফেব্রুয়ারি বাউল শাহ আবদুল করিমের ১০৫তম জন্মদিন।
অস্থির, ব্যস্ত ও প্রদর্শনবাদী নগরায়নের যুগেও এক আশ্চর্য অনাড়ম্বর জীবনযাপন করে গেছেন শাহ আবদুল করিম।আকাশচুম্বী খ্যাতি, কিংবদন্তি অভিধা আর নানা প্রলোভনও তাকে বিচলিত করতে পারেনি। কত শত পদক আর সম্মাননা পেয়েছেন। নাগরিক নানা বিউটি পার্লারেও ঢোকানো হয়েছে তাকে। কিন্তু তাতে বদলানো যায়নি এই বাউলের চেহারা।
সবকিছু উপেক্ষা করে তিনি ফিরে গেছেন সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের কালনীর তীরে। তার উজানধলে ভাঙা কুঠিরে। এখানে চিরনিদ্রায় শায়িত তার প্রিয়তমা স্ত্রী সরলা কিংবা বলা যেতে পারে ‘বাউল সম্রাটের’ জন্য অপেক্ষায় ছিলেন সরলা। তাই তো স্ত্রীর পাশে চিরনিদ্রায় রয়েছেন আবদুল করিম।
বাউল আর বাউলপনা যখন সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের রক্তচক্ষুর কোপানলে পড়ছে অহর্নিশ, আবদুল করিম তখন আত্মবিশ্বাস ও সাহসের সঙ্গে নিজেকে বাউল হিসেবে প্রচার করলেন। লালনরা লিখেছেন, ‘আমি কিছু নয় রে আমি কিছু নয়’, কিংবা ‘ভাইবে রাধারমন বলে’, তখন আবদুল করিম এসে লিখলেন, ‘বাউল আবদুল করিম বলে’ কিংবা ‘বাউল আবদুল করিম গায়’। তখনই প্রথম আমরা কোনো বাউলের মুখে নিজেকে বাউল হিসেবে দাবি করতে শুনি।
তিনি ছিলেন রাখালবালক। স্কুলে কয়েক দিন মাত্র গিয়েছেন। সারা জীবন দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেছেন। বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন তার প্রিয়তমা স্ত্রী। তবু গান ছাড়েননি বাউল করিম। বরং এসব প্রতিকূলতা তাকে আরও দৃঢ়চেতা করেছে।
গানের জন্য তাকে ধর্মজীবীরা একঘরে করেছে, স্ত্রী সরলা ও শিষ্য আকবরের জানাজায় অংশ নেয়নি এলাকাবাসী। তবু করিমকে টলানো যায়নি।
শাহ আবদুল করিম শুধুমাত্র বাউল ছিলেন না, তিনি একাধারে গণসঙ্গীত শিল্পীও। সারা জীবন শোষিত বঞ্চিতদের পক্ষে গান লিখেছেন।
২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ৯৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাউল করিম। তার মৃত্যুতে বাউল ধারার সবশেষ প্রজন্মের উজ্জ্বলতম বাতিটি নিভে যায়। এখন তো ‘বাউল’ তৈরি করে দিচ্ছে রিয়েলিটি শো!
তবে মৃত্যু আবদুল করিমকে অমরত্ব দিয়েছে। ফলে মৃত্যুর এক যুগ পরও বাংলা ভাষাভাষী শ্রোতাদের কাছে সমান জনপ্রিয় তিনি। গ্রাম থেকে শহর, রাবীন্দ্রিক পৌঢ় থেকে রক যুগের তরুণ- সবার কাছে প্রিয় তার গান। শারীরিক অনুপস্থিতি সত্ত্বেও বাঙালির সব উৎসবে আয়োজনে উপস্থিত থাকেন করিম।
সাধারণ মানুষ প্রিয় বাউলকে মনে রাখলেও করিমকে দেয়া কথা রাখেননি কর্তাব্যক্তিরা। কেননা সরকারি উদ্যোগে তার স্মৃতি ধরে রাখতে এখনও কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। দিরাইয়ের উজানদল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি করিমের নামে নামকরণ করার দাবি উঠেছিল। এই বিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। কিন্তু সে দাবিও পুরণ হয়নি।
মৃত্যুর পর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তার নামে সুনামগঞ্জ শহরে তোড়ন নির্মাণ করা হবে। সড়ক ও মিলনায়তনের নামকরণ করা হবে। অথচ তার মৃত্যুর এক যুগ পেরোলেও এসব প্রতিশ্রুতি ও দাবির কিছুই পূরণ হয়নি।
পরিবার ও ভক্ত-স্বজনদের উদ্যোগে সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের উজানদল গ্রামে আবদুল করিমের নিজ বাড়ি ও সমাধিস্থল সংরক্ষণ এবং একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। অর্থাভাবে থেমে গেছে সে উদ্যোগও।
শাহ আবদুল করিমকে ভালোবেসে ‘বাউল সম্রাট’ নামে অভিহিত করেছেন ভক্ত-অনুরাগীরা। কে কবে প্রথম তাকে এই উপাধি দিয়েছিল তা জানা যায় না। তবে তিনি আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠেছিলেন বাংলার মাটির গান, গ্রামীণ জনপদ, সেখানকার খেটে খাওয়া মানুষ, যারা দেশ ও দশের পেটে প্রতি মুহূর্তে অন্ন যোগায়, তাদের কষ্ট, মান-অভিমান, ভালোবাসা ও বেঁচে থাকার সুরের সম্রাট।
তাই কোথাও স্মৃতিচিহ্ন থাকুক বা না থাকুক, আবদুল করিম তার গান ও সুরের জন্য সম্রাট থেকে যাবেন চিরকাল।