
ভেজাল অ্যালকোহলে সয়লাব রাজধানী। বিষাক্ত এ মদপানে বাড়ছে অসুস্থতা, ঘটছে প্রাণহানি। খবর বিবিসি’র।
বিবিসি’র প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায়ই মদের নামে স্পিরিট খেয়ে মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়। ভেজাল মদ খেয়ে মারা যাওয়া বা অসুস্থ হওয়ার ঘটনাগুলোয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, এতে মূল উপাদান হিসেবে মিথানল ব্যবহার করা হয়েছে।
মিথানল বা মিথাইল অ্যালকোহল হচ্ছে স্পিরিটের সবচেয়ে অশোধিত পর্যায়।
সাধারণত এটি হালকা, বর্ণহীন ও উগ্র গন্ধযুক্ত। কাঠ বা প্লাস্টিকের কাজ, বার্নিশ বা রং করা অথবা ছাপাখানার কাজ- এমন নানা ক্ষেত্রে মিথানল ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে মদ সেবন ও বিক্রিতে বিধিনিষেধ রয়েছে।
সাধারণত সরকার অনুমোদিত কিছু ওয়্যার হাউস, লাইসেন্সকৃত পানশালা ও নানা হোটেল থেকে মদ কিনেন মানুষ। শুধু লাইসেন্সধারীরা এসব জায়গা থেকে মদ কিনতে পারবেন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মাঝেমধ্যে নানা ক্লাব ও পানশালায় অভিযান চালিয়ে মদ বাজেয়াপ্ত করছে- এমন খবর মাঝেমধ্যে প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে।
তবে আইনের কড়াকড়ি থাকলেও ক্রেতাদের একটা বড় অংশ মদ কিনে থাকেন অবৈধ বিক্রেতাদের কাছ থেকে। ক্রেতাদের এ চাহিদা কাজে লাগিয়ে ভেজাল মদ তৈরি ও বিক্রি করেন এক শ্রেণির বিক্রেতা।
রাজধানীর অন্তত চার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে কথা বলে জানা যায়, গত কয়েক সপ্তাহে মদ পানের পর বিষক্রিয়ার উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক বেড়েছে।
চিকিৎসক ও রসায়নবিদদের মতে, মিথানল মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
বাণিজ্যিকভাবে মদ তৈরি করা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্যে অ্যালকোহল পরিমাণ মানুষের গ্রহণের জন্য নিরাপদ মাত্রায় রাখেন।
অন্যদিকে, অসাধু ও অবৈধ ব্যবসায়ীরা অনেক সময় তৈরি করা মদের সঙ্গে শিল্প কারখানার কাজে ব্যবহৃত মিথানল যোগ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ চৌধুরী বলেন, খুব সামান্য পরিমাণ মিথানলেও অনেক সময় মানুষের বড় শারীরিক ক্ষতি হতে পারে। ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা মিথানলের প্রভাব একেকজনের দেহে একেকরকম হয়। অন্য স্পিরিট জাতীয় দ্রব্যের চেয়ে মিথানলের দাম তুলনামূলক কম। তাই ভেজাল মদ তৈরির কাজে মূলত এটিকেই ব্যবহার করা হয়।
২০১৭ সালে ‘অ্যনালস অব অকুপেশনাল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল মেডিসিন’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় উঠে আসে, ৪ থেকে ১২ গ্রামের মতো বিশুদ্ধ মিথানল সরাসরি সেবন করলে একজন মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে পারেন।
তবে ব্যক্তিভেদে এর চেয়ে কম পরিমাণ বিশুদ্ধ মিথানল গ্রহণেও মানুষের অন্ধ হয়ে যাওয়ার বা মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে বলে উল্লেখ করা হয় গবেষণায়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ বলেন, মিথানল শরীরে প্রবেশ করলে ব্যক্তির হার্ট অ্যাটাক হতে পারে, স্নায়ুতন্ত্রও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে- এ দুই কারণে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে।
তিনি জানান, মিথানল গ্রহণ করার পর যত সময় যায়, ততই তা শরীরের সঙ্গে মিশে যেতে থাকে। শরীরের তত বেশি ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে।
শরীরে মিথানল প্রবেশ করলে বিষক্রিয়ার কারণে কোষে অক্সিজেন সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। শরীরে অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যায় ও কিডনি সেই অতিরিক্ত অ্যাসিড বের করে দিতে পারে না।
এর ফলে কিডনি, স্নায়ুতন্ত্র, যকৃৎসহ অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক ক্ষেত্রে স্থায়ীভাবে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও ঘটে।
চিকিৎসকরা বলেন, মিথানলের বিষক্রিয়ার সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাব পড়ে চোখের স্নায়ুর ওপর। বিষক্রিয়ার শিকার হওয়ার পর বেঁচে যাওয়া অনেকে অন্ধত্ব বরণ করেন।
সাধারণত মানুষের শরীরে মিথানল প্রবেশ করার পর বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় লাগতে পারে উপসর্গ প্রকাশ পেতে।
শরীরে মিথানল প্রবেশ করার একটা নির্দিষ্ট সময় পর কিছু লক্ষ্মণ বা উপসর্গ দেখা দিতে পারে বলে জানান ডাক্তার সোহেল মাহমুদ।তিনি বলেন, মিথানল বিষক্রিয়া শুরু হলে মাথা ব্যথা, বমি হওয়া বা বমি ভাব হওয়া, বুকে জ্বালাপোড়া থেকে শুরু করে খিঁচুনিও হতে পারে। এ ছাড়া ক্লান্তি, পেটে ব্যথা, মাথা ঘোরা, চোখে ঝাপসা দেখা বা শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গও দেখা যেতে পারে। কেউ যদি সন্দেহ করেন যে তিনি মিথানল জাতীয় দ্রব্য পান করেছেন, তাহলে উপসর্গ দেখা যাওয়ার আগে অথবা উপসর্গ প্রকাশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
যেভাবে বুঝবেন মদে ভেজাল আছে কি না
দীর্ঘদীন ধরে মদপান করছেন, এমন অনেকে বাইরে থেকে দেখে বা গন্ধ শুঁকে বুঝতে পারেন, মদ ভেজাল কি না।
তবে সাধারণ মানুষের পক্ষে আসল ও নকল মদের মধ্যে পার্থক্য করা সব সময় সম্ভব নয়।
রাজধানীর কয়েকটি পানশালা সূতে জানা গেছে, মদের ভেজাল নির্ণয় করার নির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতি না থাকলেও একটি সহজ উপায় রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিক্রেতা বলেন, মদ পরীক্ষার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি- একটু মদ নিয়ে তাতে আগুন জ্বালিয়ে পরীক্ষা করা। মিথানল মিশিয়ে ভেজাল মদ তৈরি করতে হলে তাতে সামান্য হলেও পানি দিতে হবে। আর এক ফোঁটা পানি থাকলে ওই মদে আগুন জ্বলবে না। কাজেই মদে যদি আগুন জলে, তাহলে ধরে নিতে পারেন যে সেটিতে ভেজাল থাকার সুযোগ নেই।