
মিরপুর মুক্ত দিবস আজ। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলেও ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি রাজধানীর এই এলাকাটি শত্রুমুক্ত হয়। মিরপুরের যুদ্ধে শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য প্রতি বছর এ দিন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি মিরপুর মুক্ত দিবস পালন করে।
চলতি বছর করোনা মহামারির কারণে এ বছর জনসমাবেশ ও র্যালির পরিবর্তে ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়েছে।
তবে সকাল ১০টায় জল্লাদখানা বধ্যভূমিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মাধ্যমে মিরপুরের শহীদদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
বিকেল ৩টায় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক-সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন শিল্প প্রতিমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল আহমেদ মজুমদার।
মিরপুরের জন্য ১৯৪৭ ও ১৯৭১ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৭ সালে বিহার থেকে আসা মুসলিমদের ঠাঁই হয় মূলত মোহাম্মদপুর। পাশাপাশি জংলা এলাকা মিরপুরেও। তবে মোহাম্মাদপুরের বিহারিরা ছিল চাকরিজীবি বা ব্যবসায়ী শ্রেণীর। মিরপুরের বিহারিরা নিম্ন আয়ের, মূলত শ্রমিক শ্রেণীর।
১৯৭১ সালে মোহাম্মাদপুরের বসবাসরত উর্দুভাষী বিহারিদের মতোই মিরপুরের বিহারিরাও সমর্থন দিয়েছিল অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে। এ দেশীয় এই উর্দুভাষী গোষ্ঠী পাক হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে লুটতরাজেও অংশ নিয়েছিল। তবে গোল বাধে পুরো দেশ স্বাধীন হওয়ারও মাস দেড়েক পর। ঢাকা স্বাধীন হয়েছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফিরেছেন দেশে, এই আনন্দে ঢাকাবাসী তথা দেশবাসী খুশি হলেও, ঢাকায় এক টুকরো পাকিস্তান হয়ে টিকে ছিল এই মিরপুর।
পাকিস্তানিদের সরবরাহ করা বিপুল অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ মিরপুরের বিহারিদের হাতে ছিল। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পন করলেও বিহারিদের নিয়ে গঠিত সিভিল আর্মড ফোর্স আত্মসমর্পণ করেনি। উপরন্তু তারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মিরপুরে আশ্রয় নেয়। যুদ্ধের সময় বাঙালি ইপিআর, আর্মড পুলিশ ও পুলিশ সদস্যরা পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে নিহত কিংবা পালিয়ে যুদ্ধে যোগ দেয়ার কারণে প্রায় ২০ হাজার বিহারিকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে এই সিভিল আর্মড ফোর্স গঠন করা হয়। আবার অনেক পাকিস্তানি সৈন্য, ইপিসিএএফ ও মুজাহিদ সদস্য বিহারিদের বাসাবাড়িতে লুকিয়ে থেকে তাদের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছিল। আর যুদ্ধ পরবর্তী ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে ওঠা মিরপুরের বিহারিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে এই অবস্থা মেনে নেওয়ার কোনো কারণ ছিল না।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল ভারতীয় বাহিনী। মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকার দায়িত্বে ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১০ বিহার রেজিমেন্টের প্রায় এক হাজার সৈন্য। বিহার রেজিমেন্টের সৈনিকদের সঙ্গে ঢাকার বিহারিদের ভাষা আর সাংস্কৃতিক মিল ছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে সে এলাকার নিরাপত্তা নিয়ে মুক্তিবাহিনী আর মাথা ঘামায়নি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন জায়গা থেকে নিয়মিত অস্ত্র জমা নেয়া হচ্ছিল, ঝামেলা ছাড়াই। কিন্তু বেঁকে বসলেন টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকী। ১৯৭২ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি তার কাছ থেকে অস্ত্র জমা নিতে চাইলে তিনি সাফ জবাব দিলেন-‘মিরপুর এবং মোহাম্মদপুরে বিহারীরা কোন অস্ত্র জমা দেয় নাই। সে অস্ত্র আপনারা রিকভার করেন, তারপর আমাকে স্মরণ কইরেন।’ তার এই উত্তরের পর সবার নজর যায় মিরপুর আর মোহাম্মদপুরের দিকে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ২৪ জানুয়ারি পুলিশ আর সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে একটি দল গঠন করা হয়, যারা অস্ত্র উদ্ধার করবে। ২৬ জানুয়ারি ঈদ-উল-আযহা থাকায় ২৭ জানুয়ারি মিরপুর অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়।
পরিকল্পনামত, ২৭ জানুয়ারি বিকেলে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আর পুলিশের সদস্যরা মিরপুরের প্রবেশ মুখে অবস্থান নেয়। এরপর ভারতীয় সেনাবাহিনীকে অনুরোধ করলে তারা সেখান থেকে সরে আসে। মূলত বিহার রেজিমেন্টকে বিভ্রান্ত করে রেখেছিল বিহারিরা- একই ভাষাভাষী হওয়ার সূত্রে। ফলে তারা মিরপুরের সঠিক পরিস্থিতি আঁচ তো করতেই পারেনি, বরং ভুল তথ্য দিয়ে আসছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে।
২৯ জানুয়ারি কারফিউ জারি করা হয় মিরপুর এলাকায়। এর মধ্যেই অধুনা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান তার ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের খোঁজে গিয়ে হাজির হন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অস্থায়ী আস্তানায়। এটি ছিল কল্যাণপুরের পরে, মিরপুরের প্রবেশমুখে- এখন যেটাকে আমরা টেকনিক্যাল মোড় বলি।
ঢাকার পুলিশ সুপার জিয়াউল হক লোদির গাড়িতে করে তিনি মিরপুর অভিযানে যান। ৩০ জানুয়ারি বেলা ১১টার দিকে বিহারীরা যখন অতর্কিত গুলি চালানো শুরু করে তখন গুলিতে জহির রায়হান নিহত হন। মিরপুর ১২নং পানির ট্যাংকের কাছে জহির রায়হানের গুলিবিদ্ধ দেহ পড়ে ছিল। নিহত ৪২ জন সেনা সদস্যদের মধ্যে কেবল তিন-চারজনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। জহির রায়হানসহ বাকি কারো মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। ৩০ জানুয়ারি রাতেই সম্ভবত বিহারিরা সেগুলো সরিয়ে ফেলে।
২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট যখন মিরপুর অভিযানের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, কেউ ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করেননি, কতটা কঠিন সময় সামনে অপেক্ষায় রয়েছে। ২৯ জানুয়ারি সকাল সাতটায় পুলিশের ৬৩ জন ও ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৮৬ জন সদস্য মিরপুর ১২ নম্বর পানির ট্যাংকির কাছে অবস্থান নেন। পুলিশ মাইকিং করে সবার অস্ত্র জমা দেয়ার অনুরোধ করে। বিহারি এলাকা নিরস্ত্র করার জন্য অভিযান হতে পারে, এমন আশংকায় মিরপুরের প্রতিটি ঘরের দেয়ালে ছিদ্র করে অস্ত্র নিয়ে নিশানা তাক করে রাখে বিহারিরা। বেলা এগারোটার দিকে আকস্মিকভাবে একযোগে গুলি আসতে থাকে বিহারিদের বাড়ি থেকে।
এমন ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কেউই। না পুলিশ বা আর্মির কেউ। দ্রুতই সেনা ও পুলিশ সদস্যদের যোগাযোগের ওয়্যারল্যাস সিস্টেম ধ্বংস করে ফেলে বিহারিরা। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন তো হলোই, হাই কমান্ড লেভেলেরও বেশিরভাগ আহত-নিহত হয়।
প্রকৃতপক্ষে আক্রমণের শুরুতে বিহারিরাই তুলনামূলক শক্ত অবস্থানে ছিল। সন্ধ্যার পর পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে শক্তি বৃদ্ধি করে সেনাবাহিনী। মর্টার আর আর্টিলারি নিয়ে তারা চড়াও হয় মিরপুরের বিহারিদের উপর। তীব্র যুদ্ধের পর ৩১ তারিখ সকাল সাড়ে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে অস্ত্র ফেলে দেয় বিহারিরা। আত্মসমর্পণ করে। সাড়ে তেইশ ঘন্টার সংঘর্ষের পর ১১ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার করা হয় মিরপুরের বিহারী এলাকা থেকে। বিনিময়ে ঝরেছে ৪৮ সেনা সদস্য, ৫৩ পুলিশ ও জহির রায়হানসহ নাম না জানা কত বেসামরিক লোকের, তার হিসেব নেই।