যাপিত জীবন

যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে প্রাণঘাতী ভেজাল মদ

রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আশফাকুর রহমান। ঢাকার নানা বারে মদ পান করার সময় ওয়েটারদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে ওয়েটারদের মাধ্যমে মদের বোতল কিনতে শুরু করেন আশফাক। কিছু লাভ রেখে বন্ধুদের কাছে সে মদ বিক্রিতে নামেন তিনি।

ফেসবুকে একটি প্রাইভেট গ্রুপ খুলে তিনি মদের হোম ডেলিভারি শুরু করেন। এ ব্যবসা চালাতে আশফাককে মদ কোথাও সংরক্ষণ করতে হয়নি। অর্ডার পেলে বারের ওয়েটারদের মাধ্যমে বিদেশি মদ সংগ্রহ করে তিনি নিজে পৌঁছে দিতেন ক্রেতার কাছে।

তবে করোনার সময়ে বার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মদের চাহিদা যেমন বাড়ে, তেমনি সরবরাহে তৈরি হয় ঘাটতি। এ সময় পরিচিত এক ওয়েটার তাকে টিউনিং করা মদের (বিদেশি বোতলে দেশীয় মদ বা ভেজাল মদ) বোতল বিক্রির পরামর্শ দেন।

এ ধরনের ভেজাল মদের দাম কম, লাভ বেশি। আশফাক কিছুদিন এ ধরনের মদ বিক্রি করেছেন। তিনি বলেন, ‘অধিকাংশ সময় ক্রেতারা নিম্ন মানের এই মদের তফাত ধরতে পারতেন না। তবে অভিজ্ঞরা ধরে ফেলতেন। সে জন্য কয়েকবার ঝামেলায় পড়েছি। যারা বুঝতেন, তারা টাকা পরিশোধ করতেন না। এভাবে আমার বেশ কিছু টাকা খোয়া গেছে।’

আরো বলেন, ‘আমার সরবরাহ করা মদ খেয়ে কেউ অসুস্থ বা মারা যাননি। তবে কয়েক দিন আগে ভাটারা এলাকা থেকে আমার সেই সোর্স ভেজাল মদ বানানোর অপরাধে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে বলে শুনেছি। এখন ওই গ্রুপের কারও সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই।’

রাজধানীর শান্তিনগর এলাকার একজন ব্যবসায়ী নিয়মিত মদ পান করেন। তিনি জানান, করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর থেকে বাজারে বিদেশি মদের ব্যাপক সংকট তৈরি হয়েছে। ওই ব্যবসায়ী বলেন, ‘আগের দামের তুলনায় এক-দেড় হাজার টাকা বেশি দিয়েও মদ কিনেছি। তবে তিন মাস ধরে কারও কাছেই মদ পাওয়া যাচ্ছে না, যাকে ফোন করি সে-ই বলে, নাই। প্রায় তিন সপ্তাহ আগে বন্ধুদের একটা আড্ডার আয়োজন ছিল। তখন মদের জন্য একটা ফেসবুক পেজের নম্বরে ফোন দিয়েছিলাম। দুই বোতল অ্যাবসোলিউট ভদকা আনিয়েছিলাম ১১ হাজার টাকা দিয়ে। কিন্তু একটু মুখে দিয়েই বুঝেছি ঝামেলা আছে। মুখে দেয়ামাত্রই মনে হলো মুখ পুড়ে যাচ্ছে। এখন তো শুনি এসব খেয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে।’

বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিকের পিআর প্রতিষ্ঠান ফোরথটপিআরের ৪৩ কর্মী অবকাশ কাটাতে গত ২৮ জানুয়ারি যান গাজীপুরের সারাহ রিসোর্টে। সেখানে মদ পান করে ঢাকায় ফেরার পর মারা যান তিনজন। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় আরো বেশ কয়েকজনকে।

রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ৩১ জানুয়ারি মারা যান। প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে পুলিশের দাবি, ওই ছাত্রী ২৮ জানুয়ারি উত্তরার একটি রেস্তোরাঁয় মদ পান করেন। তাদের মধ্যে এক বন্ধু অসুস্থ হয়ে ৩০ জানুয়ারি সিটি হাসপাতালে মারা যান। এর পরদিন মারা যান ওই ছাত্রী। অবশ্য অসুস্থ অবস্থায় ছাত্রীটিকে হাসপাতালে ভর্তি করার পরপরই তার বাবা বন্ধুদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে একটি মামলা করেছেন।

এসব ঘটনায় ভেজাল মদের ভয়াবহতা নিয়ে তৈরি হয়েছে ব্যাপক উদ্বেগ। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভেজাল মদের কারণে রাজধানীতে মারাত্মক অসুস্থতার পাশাপাশি মৃত্যুর বেশ কিছু ঘটনা সম্প্রতি ঘটেছে। সমালোচনা এড়াতে এসব ঘটনার বেশিরভাগ চেপে যাচ্ছে ভুক্তভোগী অথবা তাদের পরিবার।

রাজধানীর কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর ও গ্রিন রোড এলাকায় রয়েছে বেশ কয়েকটি বার। এ এলাকার আশাপাশের সরকারি-বেসরকারি বেশ কয়েকটি হাসপাতালের পরিসংখ্যান বলছে, সাম্প্রতিক কয়েক মাসে ভেজাল মদ খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে।

রাজধানীর আনোয়ার খান মডেল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন, গত ছয় মাসে তারা এ ধরনের অন্তত ১৩ জন রোগী পেয়েছেন। পান্থপথের বিআরবি হাসপাতাল এমন রোগী ভর্তি হয়েছেন ১০ জনের বেশি। পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ভেজাল মদে অসুস্থ বেশ কয়েকজন। তবে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান জানাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।

বেসরকারি হাসপাতালের কয়েক চিকিৎসক জানান, পুলিশসহ অন্য ঝামেলা এড়াতে মদ খেয়ে অসুস্থরা সাধারণত হাসপাতাল এড়িয়ে চলতে চান। পরিস্থিতি গুরুতর হলেই কেবল তারা হাসপাতালে আসেন। এ ক্ষেত্রেও বেশির ভাগই সরকারি হাসপাতাল বেছে নেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘মদ পান করে অসুস্থতার ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে। তবে সঠিক পরিসংখ্যান আমরা দিতে পারব না।’

তিনি বলেন, ‘বিষাক্ত মদ পানে মারা গেছেন এমন তিন জনের দেহ এই মুহূর্তে ঢাকা মেডিক্যালের মর্গে আছে।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘বিষাক্ত মদে কিডনি ও লিভারের সমস্যা দেখা দিতে পারে। ভেজাল মদে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। এছাড়া স্নায়ুতন্ত্রেও মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।’

বিষাক্ত মদপানের প্রাথমিক উপসর্গের বিবরণ দিয়ে ডা. সোহেল বলেন, ‘খাবার অযোগ্য মিথানল শরীরে প্রবেশ করলে বিষক্রিয়ায় কোষে অক্সিজেন সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। শরীরে অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং কিডনি সেই অতিরিক্ত অ্যাসিড বের করে দিতে সক্ষম হয় না। এ কারণে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, প্রচণ্ড বমি হতে থাকে, দম বন্ধ হয়ে আসে। একপর্যায়ে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। ‘মিথানল গ্রহণ করার পর যত সময় যায়, ততই তা শরীরের সঙ্গে মিশে যায়। ফলে শরীরের আরো বেশি ক্ষতি হয়।’

ভেজাল মদ নিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক কর্মকর্তা দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, ‘আগে আমরা ভেজাল মদ বলতে যা পেতাম তা ছিল দেশীয় মদের সঙ্গে পানি বা ঘুমের ওষুধের মিশ্রণ অথবা ইথাইল অ্যালকোহলের সঙ্গে পানি বা রঙ মিশিয়ে বানানো। তবে এখন যা পাচ্ছি তা হল মিথানল, যা পূর্নাঙ্গ টক্সিক বা বিষ।’

দুলাল কৃষ্ণ জানান, ইথালন হলো রেকটিফাইড স্পিরিট, তবে এটি মিথানলের মতো অতটা প্রাণঘাতী নয়। মিথানল ব্যবহার করা হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাজে, এই মিথানল দিয়ে কাঠের আসবাবও রং করা হয়। এটা পরিপূর্ণ বিষ, আর মানুষ এটা খেয়েই মারা যাচ্ছে। ’

তিনি জানান, দেশে প্রাকৃতিক উপায়েই ইথানল তৈরি হচ্ছে, আর শিল্প কারখানার জন্য আমদানি করা হচ্ছে মিথানল। সে হিসেবে ইথানল ও মিথানল দুটি রাসায়নিকই বাংলাদেশে সহজলভ্য।

পান্থপথের বিআরবি হাসপাতালের সিনিয়র মেডিক্যাল অফিসার রকিবুল ইসলাম বলেন, ‘বিভিন্ন দেশে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালকোহলের ক্ষেত্রে মিথানল মিশিয়ে সেগুলো পানের অযোগ্য করে ফেলে হয়। তখন এটাকে বলে মিথিলেটেড স্পিরিট। এই স্পিরিট মূলত বার্নিশের দোকানসহ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্ষেত্রে কাজে লাগে।’

ডা. রকিব জানান, ইথানল ও মিথানল আলাদা করা যায় রঙ দেখে। রেকটিফায়েড স্পিরিট বা ইথানল পানির মতো সাদা হয়, তবে মিথিলেটেড স্পিরিটে বেঞ্জিনসহ অন্য উপাদান মেশানোর ফলে রঙ খানিকটা বাদামি ও হালকা গন্ধ থাকে।

ভেজাল মদের বিষক্রিয়া কীভাবে শরীরে ছড়িয়ে পড়ে তা ব্যাখ্যা করে ডা. রকিব বলেন, ‘যে ক্যামিক্যাল বডিতে যাচ্ছে তা প্রথমে রক্তে যাবে। শরীর এটাকে মেটাবোলাইজ (পরিপাক) করে। লিভার টক্সিক পাওয়ারটা নষ্ট করে। তারপর কিডনি এটাকে প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়। তাই এই ধরনের কেমিক্যাল ঢুকলে প্রথমে লিভার ও কিডনিকে আক্রান্ত করে। বেশি পরিমাণ খেলে লিভার ফেইল করে। পড়ে সেটা ব্রেইনে অ্যাটাক করে। ’

দেশে ইথানল ও মিথানল দুটি রাসায়নিকই সহজলভ্য। তবে মদে ভেজালকারীরা সম্প্রতি অত্যন্ত বিষাক্ত মিথানল ব্যবহার কেন বাড়িয়েছে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, দামের পার্থক্যই মূলত এর কারণ। এক লিটার ইথানল কিনতে খরচ হয় ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। অন্যদিকে, এক লিটার মিথানলের খুচরা দাম মাত্র ৫০ থেকে ৫৫ টাকা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ চোখে ইথানল আর মিথানলের পার্থক্য করা কঠিন। এ কারণে ভেজালকারিরা অনেক সময় না বুঝেই ইথানলের বদলে মিথানল দিয়ে মদ বানাচ্ছেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক কর্মকর্তা দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, ‘মাত্র ১২ মিলি লিটার মিথানল মানুষের পেটে গেলেই অন্ধত্বসহ মৃত্যু হতে পারে। ৬০ মিলি লিটার (এক পেগ) মদে অ্যালকোহল থাকে সর্বোচ্চ ৩০ মিলি লিটার। সেই সূত্র মেনেই ভেজালকারিরা মিথানল দিয়ে মদ তৈরি করছে।’

ভেজাল মদ চেনার জানতে চাইলে দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, ‘এটা পরীক্ষা করা ছাড়া বোঝার উপায় নেই। ল্যাবে পরীক্ষা করে তবেই নিশ্চিত হওয়া যায়।’

তবে ঢাকার একটি বারের একজন ওয়েটার জানান, মদে আগুন ধরিয়ে আসল-ভেজাল পরীক্ষা করা সম্ভব। ভেজাল মদে পানির মিশ্রণ থাকে বলে তাতে আগুন জ্বলে না।

রাজধানীর ভাটারা এলাকায় গত ১ জানুয়ারি অভিযান চালিয়ে ভেজাল মদ তৈরির একটি চক্রকে গ্রেপ্তার করে ডিএমপির গুলশান গোয়েন্দা বিভাগ। এই বিভাগের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, ‘চক্রটির ভেজাল মদ তৈরি করতে খরচ পড়ত সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা। মুনাফার জন্য তাদের মানুষ মারতেও দ্বিধা নেই। ভাটারার এই চক্রটিই মূলত উৎপাদনের কাজ করত, তারপর ছড়িয়ে দিত রাজধানী ও আশপাশের এলাকায়। এই ভেজাল মদই গাজীপুর, মোহাম্মদপুরসহ অন্যান্য জায়গায় মানুষের মৃত্যুর কারণ।’

ভেজাল মদকে নতুন হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয় পুরোন বোতলে ভরে। গত কয়েক মাসে পুরান ঢাকায় এ ধরনের বোতল বিক্রি বেড়েছে। মদের পুরোন বোতল বিক্রিতে জড়িতরা জানান, ফেলে দেয়া খালি বোতলগুলো সংগ্রহ করে টোকাই বা ভাঙারির লোকজন। তাদের কাছ থেকে একেকটি বোতল পাঁচ থেকে ১০ টাকায় কেনেন ভাঙারির দোকানিরা। এরপর সেগুলো পরিষ্কার করে ২৫ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি করা হয়।

মদের খালি বোতল পাইকারি দামে পাওয়া যায় পুরান ঢাকার নিমতলি এলাকায়। এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সম্প্রতি পুলিশের ভেজাল মদবিরোধী অভিযান শুরুর পর এখন আর প্রকাশ্যে মদের খালি বোতল বিক্রি হচ্ছে না। ব্যাবসায়ীরা জানান, এখন শুধু পরিচিত ও বিশ্বস্তদের কাছে বোতল বিক্রি করা হচ্ছে।

নিমতলীতে খালি মদের বোতল বিক্রেতাদের অন্যতম সাব্বির। নিমতলী মসজিদের ঠিক বিপরীত পাশে তার দোকানে সাজানো আছে কিছু কাঁচের কৌটা। তবে আড়ালে তার সংগ্রহে রয়েছে নানা ব্র্যান্ডের মদের খালি বোতল।

সাব্বিরের দোকানের কাছেই আরেক ব্যবসায়ী মামুনের দোকান। রাস্তার মাথায় তার ছোট ভাঙারির দোকানে অন্য পণ্যের পাশাপাশি কিছু কাঁচের বোতলও রাখা আছে। তবে পাশের আরেকটি ঘরে তার মূল গুদামে রয়েছে মদের অসংখ্য খালি বোতল।

মামুন জানান, দামি ব্র্যান্ডের বোতলের দাম একটু বেশি। আর সাধারণ আকার, বিশেষ করে গোলাকৃতির বোতল ২০ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ব্যবসায়ী বলেন, গত তিন-চার মাসে দামি ব্র্যান্ডের বোতল বিক্রি বেড়েছে। পানি খাওয়া বা শোপিস হিসেবে ব্যবহারের জন্য এসব বোতলের তেমন চাহিদা নেই। এগুলো মূলত ভেজাল মদ প্রস্তুতকারকেরা নিয়ে যান।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসেবে সারাদেশে বৈধ বার ও ক্লাবের সংখ্যা ১৮৬। এদের কোনো কোনোটি বিদেশ থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদ সরাসরি আমদানি করছে, বাকিরা আমদানিকারকদের কাছ থেকে সরবরাহ নিচ্ছে।

এর বাইরে দেশে ২০৩ মদ বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে, যার মধ্যে ১৪টি বিদেশি কূটনীতিকদের জন্য শুল্কমুক্ত ওয়্যারহাউজ।

দেশে বেশ কয়েক শর্ত ও অতিরিক্ত কর আরোপ করে মদ্যপানকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে সরকার। বার সংশ্লিষ্টদের দাবি, ওয়্যারহাউজ থেকে কূটনৈতিক পাসপোর্টের বিপরীতে প্রতি মাসে ২০০ ডলারের মদ সরবরাহের বিধান রয়েছে। তবে সিন্ডিকেট তৈরি করে এসব ওয়্যার হাউজ থেকে মদ নিয়ে বিক্রি করছিল নানা বার। এটি বন্ধে সম্প্রতি শুল্ক বিভাগ প্রতিটি ওয়্যার হাউজে অডিট শুরু করে। এর পর থেকে ‍দেশজুড়ে শুরু হয়েছে বিদেশি মদের সংকট।

ঢাকার একটি ওয়্যার হাউজের সুপারভাইজার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আগে আমাদের এখান থেকে বিভিন্ন বারে মদ যেত। শুল্ক গোয়েন্দাদের ম্যানেজ করেই সব চলছিল। তবে এবার আর তাদের ম্যানেজ করা যাচ্ছে না বলেই ঝামেলা হচ্ছে।’ মদের দাম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা একটা ব্ল্যাক লেভেল এখান থেকে দেই তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায়, সেটা বারে বিক্রি হয় আট থেকে নয় হাজার টাকায়। একটা ভ্যাট সিক্সটিনাইন আমরা দেই দেড় হাজার টাকায়, সেটা বাইরে বিক্রি হয় সাড়ে তিন হাজার টাকায়। ক্রেতারা ঠিকই বেশি দাম দিয়ে কিনে খান, কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত লাভের টাকা যায় সিন্ডিকেটের কাছে।’

পরিচয় গোপন রেখে কথা বলেছেন রাজধানীর একটি বারের ব্যবস্থাপক। তিনি বলেন, ‘আমাদের বারের মদ আমদানির লাইসেন্স আছে। আমরা একটি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ আমদানি করি। তবে আমদানি করে বিক্রি করা পর্যন্ত আমাদের যা খরচ, তা ওয়্যার হাউজ থেকে আনা মদের দামের চেয়ে ৬০০ গুণ বেশি। আমরা আমদানি করতে গেলে হাজারে ৩০০ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। এখানেই শেষ না, বিক্রি করতে গেলে প্রতি হাজারে ৩৫০ টাকা সরকার নিয়ে যায়, তার উপর আবার আছে ২০ শতাংশ ভ্যাট। তাহলে বৈধ পথে ব্যবসা করব কী করে?’

ভ্যাট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, বার বা বিভিন্ন অনুমোদিত রেস্তরাঁয় বিক্রি হওয়া মদের বেশিরভাগ আসছে অবৈধ পথে। ওয়্যার হাউজ থেকে সংগ্রহ ছাড়াও স্থলসীমান্ত দিয়ে চোরাচালান ও বিদেশিদের লাগেজে আনা হয় অবৈধ মদ। এতে সরকার বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে বলেই কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, করোনায় বিমান যোগাযোগ সীমিত হয়ে যাওয়া, সীমান্তে কড়াকড়ি ও ওয়্যার হাউজ থেকে বারে মদ বিক্রির সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়ায় বারে অবৈধ মদ কেনা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এ সংকটে বেড়েছে ভেজাল মদ তৈরির প্রবণতা।

ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান বলেন, ‘বৈধ পথে মদ আমদানি বন্ধ নেই। তবে অবৈধ পথগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এতে করে সরকারের রাজস্ব বেড়েছে। আমাদের এ অবস্থান অব্যাহত থাকবে। তবে একটি পক্ষ আমদানি বন্ধ বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে। ’

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহম্মদ আহসানুল জব্বার বলেন, ‘ভেজাল মদ তৈরি করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। কোনো বার ভেজাল মদ বিক্রির সাহস করবে না। তবু আমরা বারগুলোতে নজরদারি বাড়িয়েছি। বৈধ বারে মানুষ মদ পান করবে, এটা নিয়মের মধ্যেই আছে, কিন্তু অবৈধ মদ পেলে তো আমরা জব্দ করবই।’

মদ আমদানিতে বিপুল করের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কিছুদিন ধরে শুনছি বার মালিকেরা অতিরিক্ত শুল্কের কথা বলছেন, কিন্তু এতদিন পর শুল্ক নিয়ে কথা কেন? সরকারি শর্ত মেনেই তো তারা এই ব্যবসায় এসেছেন। এখন চুরি করতে পারছেন না বলে শুল্ক নিয়ে মাথাব্যথা। আমার স্পষ্ট কথা তারা বৈধ ব্যবসা করতে চাইলে সবসময় আমাদের সহযোগিতা পাবেন।’

দেশের প্রতিটি জেলায় সরকার অনুমোদিত বার চালুর প্রস্তাব করেছে পর্যটন করপোরেশন। সংস্থার ব্যবস্থাপক জিয়াউল হক হাওলাদার (জনসংযোগ) বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রতিটি জেলায় বার করা হবে। ডমেস্টিক ওয়েতে বারগুলো উন্নত করতে পারলে ট্যুরিস্টদের মধ্যে আস্থা বাড়বে। ট্যুরিস্টদের সঙ্গে লোকাল মানুষের কানেকটিভিটি বাড়লে স্বাচ্ছন্দ্যে টুরিস্টরা বারে প্রবেশ করতে পারবে।’

বারে শুল্ক কমানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণভাবে সরকার ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ ব্যাপারে চাইলেও আমরা কিছু করতে পারব না।’

কৃতজ্ঞতা: নিউজবাংলা২৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button