জ্ঞানজগতে রাষ্ট্র নিয়ে, রাষ্ট্রের ধারণা ও কর্মাদি নিয়ে চিন্তাভাবনা কম হয়নি। রাজনীতিবিদ্যায় রাষ্ট্র নিয়ে ইতিহাসের সামনে যেসব থিউরি আছে, সেগুলো অটুট থাকুক! বরং রাষ্ট্রে বসবাসকারী নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্র নাগরিকের ওপর কীভাবে চেপে বসতে পারে, কীভাবে শাসনকাঠামোর একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনাকারী বিভাগগুলো রাজনৈতিক ফাঁদে বন্দী হয়ে যেতে থাকে, কীভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা ভুখন্ডের সার্বভৌমত্ব এবং জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসকে ভেঙে টুকরা টুকরা করে দিয়ে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিপতি সেজে নিপীড়কের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়, সেসব নিয়ে কথা বলা দরকারি হয়ে পড়ে। অভিজ্ঞতার সাদামাটা কথা বলার জন্য রাজনীতিবিদ্যা পাঠের খুব দরকার পড়ে না। বরং বাস্তবিক যে অভিজ্ঞতা, তার সামনে এসে রাজনীতিবিদ্যা ছাত্র হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে বাধ্য হয়।
যেকোনো মত ও চিন্তা বিমূর্ত পর্যায় থেকে বের হয়ে এসে মূর্তমান হয় কাজে। রাষ্ট্রধারণা এক ধরনের চিন্তা, যা সামাজিক চুক্তি আকারে সমাজে শাসনকাঠামোর আকর হিসেবে হাজির। রাষ্ট্র সামাজিক চুক্তি হিসেবে জনগণের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, এটি নতুন কোনো কথা নয়। বরং জনগণ রাষ্ট্রের ভ‚মিকাকে কীভাবে দেখছে, রাষ্ট্রে বসবাসকারী নাগরিকরা রাষ্ট্রকে যখন প্রতিজ্ঞাভঙ্গকারী হিসেবে দেখছে, তখন নতুন করে রাষ্ট্র নিয়ে ভাবনার দরকার রয়েছে।
কারণ রাষ্ট্রের একক কোনো ধারণা বা চর্চা নেই সমাজে। বরং বহুত্ববাদে রাষ্ট্রধারণা ও রাষ্ট্রের পত্তন লক্ষ করা যায়। সার্বভৌম রাষ্ট্র যেমন রয়েছে, আবার ফেডারেল রাষ্ট্রও রয়েছে, সার্বভৌমত্ব যেখানে ফেডারেলের রাষ্ট্রের হাতে এককভাবে থাকে না। রাষ্ট্রে নাগরিক যেমন গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, আবার নাগরিকহীনতাও বর্তমান দুনিয়ায় কম সংকটের বিষয় নয়। আধুনিক রাষ্ট্র সফল কী অসফল, এ নিয়েও তর্কাতর্ক আছে; যেগুলো জরুরি অনুধাবনের জন্য, নতুন বিশ্লেষণ ও কর্মপন্থা জন্য।
আমেরিকাকে যদি সফল রাষ্ট্র হিসেবে উদাহরণ হিসেবে দেখতে চাই তা-ও যে একদম নির্ভুল হবে, তেমন নয়। দ্বিতীয় বিশযুদ্ধ-পরবর্তী বহু রাষ্ট্র আমেরিকার মডেলকে অনুসরণ করলেও অনেক রাষ্ট্রের দুর্গতিও আমাদের সামনে রয়েছে। ইউরোপের কথিত কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোর কপালও যে খুব ভালো যাচ্ছে, সাম্প্রতিক ইতিহাস এমন বলে না। যে আমেরিকা যুদ্ধ, সহিংসতা, দখলদারিত্ব আর করপোরেট পুঁজির দাপট দিয়ে বিশ্ব শাসন করতে চায়, সেই রাষ্ট্র বলপ্রয়োগকারী হিসেবে নাম-যশ অর্জন করতে পারে, কিন্তু তার নিজের নাগরিকের বিপন্নতা নিয়ে তাকে কম ভাবলে চলবে কেন? কিংবা কেবল নিজের নাগরিকের নিরাপত্তা নিয়ে ভেবে অন্য রাষ্ট্রের নাগরিকদের বিপন্নতাকে ঘনিয়ে আনাও রাষ্ট্রের সুচিন্ত কাজ হতে পারে না। ইউরোপের সামনে আজকে যে সংকট, তা নিঃসন্দেহে মানবিকতার সংকট। রাষ্ট্রকে প্রথমত, নাগরিকের প্রতি মানবিক হতে হবে এটিই আধুনিক রাষ্ট্রের প্রথম শর্ত।
২.
রাষ্ট্র যেমন বিমূর্ত ধারণা, একইভাবে রাষ্ট্র বানানোর আকাক্সক্ষাও বিমূর্ত। কিন্তু আকাক্সক্ষা যখন মূর্ত হয়, তখন যে ফাঁদ তৈরি হয় সেই ফাঁদেই জনগণ শৃঙ্খলিত হয়। ফলে ‘রাষ্ট্র’ ধারণা আকারে এক ধরনের শৃঙ্খলিত ধারণা।
রাষ্ট্র নিজেই জনগণের অস্তিত্ব বিনাশ করে দিতে পারে। এমনকি তার নিজের দেহ নিজেই ভক্ষণ করে ফেলতে পারে। এই বিনাশী কর্মকান্ড রাষ্ট্র করে যখন জনগণের সাথে রাষ্ট্রের ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো সম্পর্ক থাকে না। আর এই বিনাশী তৎপরতা ঘটে রাজনীতি দ্বারা, মানুষের বিপক্ষের রাজনীতি দ্বারা।
রাজনীতি যদি আত্মপরিচয়ের সংকট কাটাতে না পারে, তাহলে তার দুর্ভোগের শেষ নেই। রাজনীতির কাজ জনপ্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা; রাষ্ট্রকে দিয়ে জনগণের পায়ে শেকল পরানো তার কাজ নয়। জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে রাষ্ট্রকে দাঁড় করানো কাজ নয়।
রাজনীতির ধরন ও স্বরূপ কেমন হবে, এটা নির্ণয় করবে জনগণ, রাষ্ট্র নয়। রাজনীতির রূপ ঠিক করবে ইতিহাস। কিন্তু ইতিহাসে নির্মমতা আছে, ইতিহাসের পরিহাসও আছে। পরিহাস হচ্ছে বেদনাবিধৌত, রাষ্ট্র ও জনগণকে এর দায় বহন করতে দেখা গেছে ইতিহাসে।
আধুনিক রাষ্ট্র বলতে যা বোঝায়, তা হচ্ছে ন্যায্যতা ও জনঅধিকারের প্রতি সম্মান রেখে জনপ্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করে জনসেবাকে নিশ্চিত করা, জনঅধিকার ও মর্যাদাকে নিশ্চিত করা।
রাষ্ট্রের সাথে সমাজের সম্পর্ক, জনগণের সম্পর্ক, ধর্ম ও কৃষ্টি-সংস্কৃতির সম্পর্কের ধরন কেমন হবে, তা রাষ্ট্রকে আমলে নিতে হয়। রাজনীতিকেও আমলে নিতে হয় সমাজের প্রতি তার দায় ও কর্তব্য। দায় এড়িয়ে সভ্য রাজনীতি চলতে পারে না, রাষ্ট্রও জনগণের প্রতি তার দায় এড়াতে পারে না। কারণ রাষ্ট্র তৈরি করে জনগণ।
ইতিহাসে দেখা যায়, কথিত আধুনিক রাষ্ট্রও জনঅধিকারকে গুরুত্ব না দিয়ে করপোরেটের দাসানুদাস হয়ে যাচ্ছে, মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রির হাতে সঁপে দিচ্ছে, যুদ্ধ ও হিংসা-প্রতিহিংসাকে উসকে দিচ্ছে। বর্তমান দুনিয়ার বড় সংকট আধুনিক রাষ্ট্রগুলোতেই বেশি প্রতীয়মান হচ্ছে। আর যেসব রাষ্ট্র নিজেই দাঁড়াতে পারছে না ঠিকমতো তার কারণ জনগণের প্রতি তার দায় এড়িয়ে গিয়ে রাজনীতির লালসাকে চরিতার্থ করা।
বর্তমান দুনিয়ার সংকট কাটাতে হলে যুদ্ধ, মিলিটারি ও করপোরেট শক্তির হাতে সঁপে দেয়া নয়, বরং জনগণের সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা আরও বেগবান করা, আরও প্রগতিশীল করা জরুরি।
অতীতের ঐতিহ্য ও জ্ঞানবিজ্ঞানকে পুনর্জাগরণ করে রাষ্ট্র আধুনিক হতে পারে, আর আধুনিক রাষ্ট্রগুলো তার সংকট থেকে মুক্তি পেতে পারে। তবে রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের সম্পর্কের স্বরূপ কী হবে, তা যেমন পর্যালোচনা করতে হবে, একইভাবে রাষ্ট্রের আইন, রীতিনীতি ও সমাজের অন্যান্য উপাদান নিয়ে তর্ক ও মীমাংসা করতে হবে। রাষ্ট্রে বিভক্তি নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তির ঐক্য জারি রাখতে হবে।
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে আধুনিক হতে হলে মানুষের পক্ষে রাজনীতি যেমন করতে হবে, মানুষের কাছেও রাষ্ট্রের সেবা ও দায়িত্বকে পৌঁছে দিতে হবে। আর এক্ষেত্রে রাজনীতিকে হতে হবে মানুষের পক্ষের রাজনীতি। না হয়, রাজনীতি যেমন টিকবে না, মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে রাষ্ট্রের টিকে থাকাও দায় হবে।
কারণ রাষ্ট্রে বৈধ ও অবৈধ নামক বিষয় বা উপাদান আছে। রাষ্ট্রের বৈধতা কেবল ভৌগোলিক নয়, বরং রাষ্ট্র মানুষের পক্ষে কিনা, রাষ্ট্রে ন্যায্যতা ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে অটুট কিনা, জনঅধিকার নিশ্চিতের প্রশ্নে রাষ্ট্র দায়বদ্ধ কিনা, রাষ্ট্র নিজস্ব প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার প্রশ্নে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কিনা, রাজনীতি ও কর্মসূচি গ্রহণের প্রশ্নে জনগণের পক্ষে কিনা, সেসব বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার প্রশ্নে।
একটি কার্যকর রাষ্ট্রে মানুষের মানবিক মর্যাদা জারি থাকে সব সময়। রাষ্ট্র নাগরিকের জীবনের দায় নেয়। খুন, রাহাজানি, অবাধ লুটপাট ও অন্যায্যতাকে রাষ্ট্র কখনো প্রশ্রয় দেয় না। রাষ্ট্র টিকে থাকে মানবিকতার ওপর, স্বৈরমনোভাবের ওপর নয়। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র নিশ্চয়ই প্রগতিশীলতার পথে, অসাম্প্রদায়িকতার পথে, মানবিকতার পথে হাঁটবে, মুক্তিযুদ্ধ করা বীরের জাতি হিসেবে এই আশা আমরা করতেই পারি।
৩.
রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ অধিকতর নতুন। নতুন রাষ্ট্র হিসেবে তার দায় ও কর্তব্য ছিল অনেক বেশি। তার প্রথম কাজ ছিল সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে জনগণের কাছে তার আস্থা ও বিশ্বস্ততাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। রাষ্ট্রের অন্যান্য উপাদান ও বিভাগের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা। রাষ্ট্র ও সরকারের জবাবদিহিতাকে নিশ্চিত করা। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথেষ্ট স্বাধীন ও শক্তিশালী করা। তার কাজ ছিল নাগরিক পরিষেবাকে জনগণের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেয়া; ন্যায়বিচার, ন্যায্যতা ও অধিকারের প্রশ্নে আপসহীন থাকা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, রাষ্ট্র পরিচালনাকারী বা রাষ্ট্রের মূল অনুঘটকগুলোর রাজনৈতিক অভীপ্সা যদি কেবল ক্ষমতা ও বলপ্রয়োগের জন্য বরাদ্দ থাকে, শেষমেশ সেই রাজনীতি ইতিহাসে আস্তাকুঁড়ে গিয়েই পড়ে থাকে। তার এই নির্মম নিয়তির দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে জনগণের বরাত দিয়ে ইতিহাস নতুন রাজনীতির উন্মেষ ঘটায়। উপমহাদেশের রাজনীতির দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, যেসব দাঙ্গা-হাঙ্গামা, নির্মমতা, নিপীড়ন ও হিংসা-প্রতিহিংসার আগুন জ্বলতে দেখা গেছে মানুষে মানুষে, দলীয় রাজনীতি-রাজনীতিতে সেসবের ভাগ্য খুব সুপ্রসন্ন হতে দেখা যায়নি ইতিহাসে।
লেখক: আহমেদ স্বপন মাহমুদ/ কবি ও উন্নয়নকর্মী