এক সময় ঘুড়ি, নাটাই ও মাঞ্জাতে সীমাবদ্ধ থাকলেও সাকরাইনের পরিসর এখন ব্যাপক। দিনের প্রথম পর্বে চলে ঘুড়ি কাটাকাটির প্রতিযোগিতা। গোত্তা খাওয়া ঘুড়ি ও ‘ভোকাট্টা’ রবের সঙ্গে সাউন্ড সিস্টেমের তালে গানবাজনা ও আনন্দ-উল্লাস, যা চলতে থাকে শীতের মিষ্টি বিকেলজুড়ে।
রাজধানীর ইতিহাস প্রায় চারশ বছরের। এ ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে রয়েছে পৌষ সংক্রান্তি। পঞ্জিকামতে, বাংলা পৌষের শেষের দিন উদযাপিত হয় পৌষ সংক্রান্তি। ঢাকাইয়া ভাষায় ‘সাকরাইন’ নামেই এটি অধিক পরিচিত। পৌষ সংক্রান্তি, সংক্রান্তি বা সাকরাইন যেভাবেই বলা হোক এ উৎসবের প্রস্তুতি চলে ঘটা করে।
সময়ের সঙ্গে সর্বজনীন ঢাকাইয়া উৎসবে রূপ নেয়া এ উৎসব উদযাপনের ধরনে এসেছে পরিবর্তন। এ ছাড়া চলতি বছরের আয়োজনে করোনার প্রভাবও কিছুটা থাকছে।
পুরনো ঢাকাবাসীর প্রাণের এ উৎসবের জন্য নতুন বছরের শুরু থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি থাকে। ১৪ ও ১৫ জানুয়ারি চলবে এ উৎসব। সাধারণত ১৪ জানুয়ারিতে সাকরাইন পালন করতে দেখা যায়। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন পঞ্জিকা অনুসারে পরদিন পালন করে থাকে। তবে ধর্মীয় দিকের চাইতে সাকরাইন আয়োজনে প্রাধান্য পায় মূলত এলাকার অবস্থান।
এলাকাভেদে দুইদিনের ভেতর যেকোন একদিন সাকরাইনের জন্য নির্ধারণ করা থাকে। পুরান ঢাকার শাঁখারিবাজার, তাঁতিবাজার, কলতাবাজার, শিংটোলা, কাগজীটোলা, সূত্রাপুর , লক্ষীবাজার, বাংলাবাজার, ফরাশগঞ্জ, বানিয়ানগর, আইজি গেট, আরসিন গেট, গেন্ডারিয়া ইত্যাদি এলাকা সাকরাইনের দিনে যেন নতুন প্রাণ পায়।
সূত্রাপুর এলাকায় যেসব বাড়িতে জাঁকজমকপূর্ণভাবে সাকরাইন উৎসবের আয়োজন করা হয়, তন্মধ্যে একটি হলো ‘কেটলি বাড়ি’। বাড়ির ছাদে সুদৃশ্য কেটলির নকশা থাকায় এমন নামকরণ।
একটা ঘুড়ির দাম যদি সাধারণ সময়ে পাঁচ টাকা হয়, তবে সেটাই সাকরাইনের আগের দিন বেড়ে দাঁড়ায় ১০-১৫ টাকায়। ঘুড়ির মাঞ্জা (সুতা ধারালো করার জন্য যেসব উপাদান) ৫০ টাকায় বিক্রি হয়, সেটাই মূল দিনে ৩০০ টাকায় বিকোয়। ফলে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকেই এসব সংগ্রহের তোড়জোড় শুরু হয়।
ঘুড়ি, নাটাই, আতশবাজি, ফানুস, মাইক্রোফোন সবকিছুই আলাদাভাবে এলাকার অল্পবয়সীরা জড়ো করতে থাকে। ছাদ ডেকোরেশনের পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করেই মূলত বাজেট নির্ধারণ করা হয়। কার ছাদ কত সুন্দর ও আকর্ষণীয়- তা নিয়ে চলতে থাকে প্রতিযোগিতা।
পরিকল্পনার পাশাপাশি চলে চাঁদা সংগ্রহ।
পুরনো ঢাকার বাইরে থেকেও অনেকে এসে সাকরাইন উৎসবে যোগ দেন। জ্যাম আর ভিড় ঠেলে পুরনো ঢাকার অলিগলিতে পা রাখার পর যদি মূল আয়োজনে সামিল না হতে পারেন তবে দিনটাই যেন বৃথা!
নামমাত্র এন্ট্রি-ফী বা টিকিটের মাধ্যমে ছাদগুলোর আয়োজনে যুক্ত হতে পারবেন। অনাকাঙ্ক্ষিত বা অনাহূত কেউ এসে যেন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে সেজন্যেই আসলে আগত অতিথিদের এভাবে একটা গণনার ভেতর রাখা হয়। অনেক ছাদে থাকে টিশার্ট, ব্যাজ বা হ্যান্ডব্যান্ডের ব্যবস্থাও।
সন্ধ্যা নামতেই শুরু হয় চোখ ধাঁধানো আতশবাজির প্রদর্শনী। লেজার শো আর ‘ডিস্কো লাইট’-এর পাশাপাশি কেউ কেউ কেরোসিন মুখে মশালে ফুঁ দিয়ে অগ্নিকুণ্ড তৈরি করে; সন্ধ্যার আকাশে ঘুড়ির জায়গা নেয় রঙিন ফানুস। আলোর ঝলকানিতে ঢেকে যায় পুরনো ঢাকার সম্পূর্ণ আকাশ।
এবারের বিক্রিবাট্টায় করোনার প্রভাব তেমন নেই। মহামারী চললেও শিশু কিশোরদের সাকরাইন উৎসব পালন বন্ধ নেই। বরং মেয়র সাহেবের উদ্যোগে এবার সাকরাইন হবে আরও বড় পরিসরে। ঢাকাইয়াদের এ উৎসবকে এবার আরও গৌরবান্বিত করে প্রচার করা হবে।
প্রসঙ্গত, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) উদ্যোগে এবার ৭৫টি ওয়ার্ডে একসঙ্গে ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব হবে। ‘এসো ওড়াই ঘুড়ি, ঐতিহ্য লালন করি’ স্লোগানে এ উৎসব পালনের উদ্দেশ্যে কাউন্সিলরদের কাছে ১০০ করে মোট ১০ হাজার ঘুড়ি সরবরাহ করা হবে। বেলা দুইটা থেকে শুরু হয়ে রাত আটটা পর্যন্ত চলবে এ আয়োজন।